খাবার গরম করা থেকে শুরু করে বিভিন্ন খাদ্য প্রস্তুতে যে জিনিসটি আমরা অনেকেই প্রায় প্রতিদিনই ব্যবহার করে থাকি তা হলো মাইক্রোওয়েভ ওভেন। এই যন্ত্রটিতে Microwave নামের একটি কম তরঙ্গদৈর্ঘ্য বিশিষ্ট তরঙ্গ ব্যবহার হয়ে থাকে। এই তরঙ্গটিই মাইক্রোওয়েভ ওভেনের কার্যকারিতার মূলনীতির পেছনে কাজ করে থাকে।
সাধারণ ওভেন এবং টোস্টার প্রচণ্ড উত্তাপ উৎপাদনের মাধ্যমে কাজ সম্পাদন করে থাকে। অপরপক্ষে মাইক্রোওয়েভ ওভেন এই একই কাজ করে Microwave নামের তরঙ্গ ব্যবহারের মাধ্যমে।
মাইক্রোওয়েভ বা Microwave কি?
Microwave হলো এক ধরণের ইলেক্ট্রো ম্যাগনেটিক ওয়েভ যার তরঙ্গ দৈর্ঘ্য সাধারণ রেডিও সিগন্যাল থেকেও ছোট। সাধারণত মাইক্রোওয়েভের তরঙ্গদৈর্ঘ্য ১ মিটার থেকে ১ মিলিমিটার পর্যন্ত হয়, অর্থাৎ এর ফ্রিকোয়েন্সি ৩০০ মেগাহার্টজ থেকে ৩০০ গিগাহার্টজের মধ্যে থাকে।
নানা রকমের প্রযুক্তিতে এই ওয়েভ এর ব্যবহার রয়েছে। রাডার, যোগাযোগ ব্যবস্থার পাশাপাশি মাইক্রোওয়েভ ওভেনেও এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়।
মাইক্রোওয়েভ ওভেন এর কার্যপ্রনালী:
মাইক্রোওয়েভ ওভেনের ভিতরে ম্যাগনেটিউব নামের এক ধরণের ইলেকট্রন টিউব আছে যা Microwave তৈরি করে থাকে। এই তরঙ্গ আমাদের খাবারের অণুকে উদ্দীপিত করে, তাড়িত করে এবং নড়াচড়া ও ঘুরতে শুরু করে, এর ফলে একটি অণু অন্যটির ধাক্কা লাগে। এর ফলে উৎপন্ন শক্তিই তাপশক্তি রূপে প্রকাশ পায় আর খাবারকে গরম করে তোলে।
কাজের শুরুতে এই প্রযুক্তি পানির অণুর উপরে কাজ করে, পরবর্তীতে এটি খাবারে উপস্থিত চর্বি ও স্যুগার অণুগুলোকেও উদ্দীপিত করে তোলে। তবে এই অণুগুলোর উপরে এই তরঙ্গের প্রভাব পানির অণুর অপেক্ষা কম।
Microwave কি ক্ষতিকর?
এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে আমাদের আগে বুঝতে হবে রেডিয়েশন আসলে কি জিনিস। আর সব রেডিয়েশনই কি খারাপ নাকি! উত্তর হলো কিছু কিছু ক্ষেত্রে অবশ্যই সব রেডিয়েশনই কোনো না কোনো ভাবে ক্ষতিকর।
কিন্তু আমাদের মাথায় রাখতে হবে মাইক্রোওয়েভের রেডিয়েশন আসলে এটমিক বোম কিংবা পারমানবিক চুল্লি থেকে বের হওয়া রেডিয়েশন না। এর সাথে যদি কারো খুব মিল থেকে থাকে তবে তা হলো আমাদের মোবাইল থেকে বের হওয়া ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন এর।
একটা লম্বা সময় এই ধরণের রেডিয়েশনের মাঝে থাকাটা অবশ্যই বিপদজনক হতে পারে, কিন্তু একজন মানুষের মাইক্রোওয়েভের সামনে থাকার সময়টা আনুপাতিক হারে বেশ কম। একই সাথে এই ধরণের ওভেনের দরজাতে রেডিয়েশনের বিপক্ষে সুরক্ষা দেওয়া আছে। আমাদের মাথায় একটা বিষয় রাখতে হবে আলোও এক ধরণের ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ। তাই সকল রেডিয়েশন থেকেই যে আমাদের ক্ষতি হবে এটা ভেবে নেওয়াটা ঠিক না।
তবে, কখনই ওভেনের পাল্লার সাথে মুখ লাগিয়ে রাখা উচিৎ নয়। অনেক পুরানো মাইক্রোওভেন যার দরজা নষ্ট হয়ে গিয়েছে কিংবা নষ্ট হওয়ার পথে সেগুলো ব্যবহার না করাই ভালো। আর সম্ভব হলে এটি ব্যবহারের সময় অন্তত এক ফুট দূরে দাঁড়িয়ে থাকা উত্তম।
পুষ্টি উপাদানের উপরে মাইক্রোওয়েভের প্রভাব:
Microwave কি খাবারে রেডিয়েশন ছড়িয়ে দিতে পারে কি না?
উত্তর হলো না। ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন শোষণ করা মানেই কোনও কিছু তেজস্ক্রিয় হয়ে যায় না। আমরা মানুষরাও প্রতিনিয়ত নানা রকমের ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন শোষণ করে যাচ্ছি। এর মানে এই না যে আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ছি।
Microwave কি আমাদের খাবারের মানকে নিচে নামিয়ে দেয়?
আমরা জানি যে, রান্নার সময় অনেক পুষ্টি গুণ নষ্ট হয়ে যায়। এই ব্যাপারগুলো মূলত নির্ভর করে একটা খাবার কতটা সময় নিয়ে উত্তপ্ত করা হবে, কতটা পরিমাণ উত্তপ্ত হবে, কি ধরণের খাবার রান্না করা হবে, এতে পানির পরিমাণ কেমন হবে ইত্যাদি। Microwave এ সাধারণ রান্নার প্রণালীর থেকে কম সময় উত্তপ্ত করা হয়, আর এতে সরাসরি তাপ দেওয়া হয় না, এতে পানির উপস্থিতি নেই সেজন্য অনেক ক্ষেত্রেই এতে পুষ্টিমান বজায় থাকে।
তবে একটা গবেষণায় দেখা গিয়েছিলো রসুনের ক্যান্সার-রোধী উপাদানের পরিমাণ Microwave এর প্রভাবে কমে যায়। আবার আরেকটি গবেষণায় দেখা দিয়েছে ব্রকলির ক্যান্সার-রোধী উপাদানের মাত্রা বেড়ে গিয়েছে।
অর্থাৎ Microwave ওভেনে কি ধরণের কাজ করা হচ্ছে এরে উপরে নির্ভর করে এর প্রভাবও নির্ভর করবে। একই সাথে এখানে তেলের ব্যবহার হয় না , যার ফলে অনেকক্ষেত্রেই হার্টের রোগীদের জন্য ওভেন বেইকড খাবার ভালো পুষ্টি মাধ্যম হতে পারে।
মাইক্রোওয়েভ ওভেন ব্যবহার নিয়ে কিছু সতর্কতা:
Microwave ওভেন যেহেতু রেডিয়েশন ব্যবহার করে সেহেতু কিছু সতর্কতা অবলম্বনের প্রয়োজন রয়েছে। নিচে কিছু উল্লেখ করা হলো:
১. পুরানো যন্ত্র ব্যবহার না করা।
২. নুন্যতম ১ ফুটের মতো দুরুত্ব রাখা
৩. প্লাস্টিকের কিছুর মাঝে রেখে তাপ না দেওয়া। এটি ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। এবং এটি মেনে চলা খুবই দরকারি।
৪. খাবার পরিপূর্ণভাবে তাপ দেওয়া। কম তাপ দিলে এতে উপস্থিত ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া মারা যাবে না, আবার বেশি তাপ দিলে খাবার তার পুষ্টি গুণ হারিয়ে ফেলবে। পোড়া জিনিসে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে।
Microwave নিয়ে অনেক মিথ কিংবা ভ্রান্তধারনা আছে । যার বেশির ভাগই আমাদের অতি রঞ্জিত কল্পনার ফল। তবে আমাদের অবশ্যই উপরের সতর্কতাসমূহ মেনে চলা উচিৎ। কারণ, যে কোনও কিছুতেই সাবধানতার বিকল্প নেই।