ভিটামিন কাকে বলে? এটি কত প্রকার এবং কি কি?

আমরা প্রতিদিন যে খাবার গ্রহণ করে থাকি তা নানা রকমের পুষ্টি উপাদানে পরিপূর্ণ থাকে। এই সকল উপাদান আমাদের শরীরের ক্ষয় পূরণ করে এবং বিভিন্ন রকমের শরীরবৃত্তীয় কাজে সহায়তা করে। যার মাঝে রয়েছে বিভিন্ন রকমের ভিটামিন, মিনারেল এবং ফাইটোনিউট্রিয়েন্ট। এই প্রবন্ধে আমরা ভিটামিন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো। 

ভিটামিন বা Vitamin কাকে বলে?

Vitamin বা ভিটামিন হলো এমন এক ধরনের পুষ্টি উপাদান যা খুব সামান্য পরিমাণে প্রয়োজন হয় এবং আমাদের শরীরের বিভিন্ন রকমের কাজ সম্পন্ন করতে সাহায্য করে।  এর অপরনাম হলো খাদ্যপ্রাণ। রাসায়নিক দিক থেকে এরা হলো কার্বন, অক্সিজেন ও হাইড্রোজেন জাত এক ধরনের জৈব্যযৌগের একটি গ্রুপ। 

নানা রকমের খাবার থেকে আমরা এর বড় একটা অংশ পেয়ে থাকি। কিছু কিছু ভিটামিন আমাদের শরীরেই সামান্য পরিমাণে তৈরি হয়ে থাকে। শরীরে এটির অভাব দেখা দিলে নানা রকমের প্রতিবন্ধকতা দেখা দিতে পারে। 

ভিটামিনের প্রকারভেদ (Types of Vitamin)

ভিটামিন মূলতঃ দুই প্রকার:  ফ্যাট সলিউবল এবং ওয়াটার সলিউবল

1. ফ্যাট সলিউবল

নাম থেকে বুঝা যাচ্ছে এই ধরনের খাদ্যপ্রাণ ফ্যাট বা চর্বিতে দ্রবিভুত হতে পারে। শরীর এই Vitamin গুলোকে ফ্যাটি টিস্যু এবং লিভারে জমিয়ে রাখে দিনের পর দিন। অনেক সময় এই অবস্থায় এরা মাসও কাটিয়ে দিতে পারে। Vitamin A, D, E এবং K হলো ফ্যাট সলিউবল বা Fat Soluble Vitamin.

2. ওয়াটার সলিউবল:

এরা পানিতে দ্রবণীয়। এদেরকে সঞ্চয় করে রাখা যায় না। পানিতে মিশে যায় বলে অতিরিক্ত পরিমাণে জমা হলে মূত্রের সাথে বের হয়ে যেতে পারে। Vitamin C এবং সকল প্রকার B Vitamin ওয়াটার সলিউবল বা Water Soluble Vitamin

মুত্রের সাথে বেড়িয়ে যাওয়ার কারণে এই খাদ্যপ্রাণসমুহ সাধারণত শরীরে জমে টক্সিসিটি তৈরি করতে পারে না। 

ভিটামিনের ধরণ এবং উৎস:

মানবদেহে ১৩ রকমের স্বীকৃত অত্যাবশ্যকীয় Vitamin প্রয়োজন হয়। নিচে এদের নাম, অভাবজনিত রোগ এবং উৎস সম্পর্কের দেওয়া হলো। 

 1. ভিটামিন এ

এটি চোখের সুস্থতার জন্য অত্যাবশ্যকীয়। এর অভাবে রাতকানা রোগ হয় এবং দৃষ্টি শক্তি কমে যায়। একই সাথে এই উপাদান ত্বকের সুস্থতার জন্য খুবই গুরুত্বপুর্ণ। ছোট মাছ, গাজর, কলিজা, কড লিভার অয়েল ইত্যাদি খাবারে প্রচুর পরিমাণে  ভিটামিন এ পাওয়া যায়।

2. ভিটামিন বি

বিভিন্ন পরস্পর সম্পর্কিত ভিটামিনের এর একটি গ্রুপ হলো ভিটামিন বি। সর্বমোট ৮টি উপাদান নিয়ে এই গ্রুপ গঠিত। এদের প্রতিটির আলাদা আলাদা কাজ রয়েছে। এদের উৎসের মাঝেও ভিন্নতা রয়েছে। কিন্তু এদের পারস্পরিক সম্পর্কের কারনে এদের মিশ্রণে তৈরি ফুড সাপ্লিমেন্ট পাওয়া যায়। একে বলা হয় ভিটামিন বি কমপ্লেক্স। নিচে এই পুষ্টিউপাদানের বিভিন্ন প্রকার সম্পর্কে সংক্ষেপে দেওয়া হলো:

ভিটামিন বি১

নানা রকমের এনজাইম তৈরি ও শর্করার ভাঙ্গনে সাহায্য করে। এর অপর নাম হলো থিয়ামিন। এই Vitamin এর অভাবে বেরিবেরি রোগ হয়। ইস্ট, ব্রাউন রাইস, সূর্যমুখীর বীজ, ফুলকপি, ডিম, কলিজা ইত্যাদি ভিটামিনের মূল উৎস।

ভিটামিন বি২

এর আরেক নাম হলো রিবোফ্লাভিন। দৈহিক বৃদ্ধি ও কোষের সুস্থতার জন্য প্রয়োজনীয়। এর অভাবে ঠোটে আর মুখে সাদা সাদা ঘা হয়। কলা, ঢেঁড়স, দুধ, দই, মাছ, মাংস, ডিমে Vitamin B2 পাওয়া যায়।

ভিটামিন বি৩

একে নিয়াসিনও বলা হয়। কোষের কর্মকাণ্ড সঠিক পরিচালনাতে সাহায্য করে। এর পরিবর্তনে পেলাগ্রা নামে এক ধরনের অসুখ হয়। এর উৎস হলো মুরগী ও গরুর মাংস, দুধ, ডিম, টমেটো, ব্রকলি, গাজর ইত্যাদি।

ভিটামিন বি৫

হরমোন ও শক্তি উৎপাদন এর প্রধান কাজ। এর অভাবে প্যারেস্থেসিয়া রোগ হয়। মাংস, ব্রকলি, এভোকাডো, টকদই ইত্যাদি ভিটামিন B5 এর উৎস।

ভিটামিন বি৬

লোহিত রক্ত কণিকা তৈরির প্রক্রিয়া Vitamin B6 ছাড়া বাধাপ্রাপ্ত হয়। এটির অভাবে রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়। গরুর কলিজা, কলা, বাদামে এই ভিটামিন পাওয়া যায়।

ভিটামিন বি৭

এর অপর নাম হচ্ছে বায়োটিন। শর্করা, আমিষ, চর্বি জাতীয় খাবার মেটাবলিজমে সাহায্য করে। এর অভাবে ত্বকে ও ক্ষুদ্রান্ত্রে সমস্যা দেখা দেয়। ডিমের কুসুম, কলিজা, ব্রকলি, পালং শাকে প্রচুর পরিমাণে Vitamin B7 আছে।

ভিটামিন বি৯

ফলিক এসিড এই ভিটামিনের অন্তর্ভুক্ত। DNA ও RNA তৈরিতে এর অবদান রয়েছে। এর অভাবে সন্তান বিকলাঙ্গ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কলিজা, শিম জাতীয় খাদ্য, মটরশুঁটি ইত্যাদিতে Vitamin B9 রয়েছে।

ভিটামিন বি১২

স্নায়ুকোষের বিকাশে প্রয়োজন। কিছু ধরণের রক্ত-স্বল্পতাজনিত অসুখ এবং স্নায়ুর রোগ এর অভাবে হয়ে থাকে।

3. ভিটামিন সি

কোলাজেন তৈরি, হাড়ের গঠন, ক্ষত পূরণসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে। এর অভাবে স্কার্ভি রোগ হয়। সাইট্রাস জাতীয় ফল (কমলা, মাল্টা, জাম্বুরা, লেবু ইত্যাদি), পেয়ারা, মরিচে প্রচুর Vitamin C রয়েছে। 

4. ভিটামিন ডি

হাড়ের গঠনে সাহায্য করে। এর অভাবে হাড় ভঙ্গুর হয়ে যায়, বাচ্চাদের রিকেটস রোগ হয়। আমাদের শরীরে ভিটামিন ডি নিষ্ক্রিয় অবস্থায় থাকে। সূর্যের আলোর সংস্পর্শে এটি সচল হয়। এছাড়া তেলযুক্ত মাছ, ডিম, মাশরুম, গরুর কলিজাতে Vitamin D রয়েছে।

5. ভিটামিন ই

ত্বককে সুস্থ প্রদানে দরকারি ভূমিকা রাখে। কিন্তু এই উপাদান ত্বকের উপকার ছাড়াও হাড়ের গঠনেও সাহায্য করে। এর অভাবে ত্বকের স্বাস্থ্য নষ্ট হয়। কিউই, কাঠ বাদাম, ডিম, বাদাম Vitamin E এর বড় উৎস।

6. ভিটামিন কে

ক্ষত থেকে রক্ত পড়া বন্ধের প্রক্রিয়ায় এর বিকল্প নেই। অনেক ক্ষেত্রেই এই খাদ্য উপাদানকে গুরুত্ব দেওয়া না হলেও এর অভাব প্রাণঘাতি হতে পারে। এর অভাবে রক্ত তঞ্চনে সমস্যা দেখা দেয়। কুমড়া, ডুমুর, নানা পদের শাক ইত্যাদি Vitamin K এর উৎস। 

ভিটামিনের উপকারিতা: 

মানবদেহে খাদ্যপ্রাণ বিভিন্ন রকমের গুরুত্বপুর্ণ কাজ করে থাকে। এই সকল কাজ এতটাই গুরুত্বপুর্ণ যে এদের কিছু কিছু ব্যতীত আমাদের মানবদেহের টিকে থাকাটাই কঠিন হয়ে যাবে। তবে নিচে কিছু উপকারিতা উল্লেখ করা হলো: :

  • স্বাস্থ্যকর ত্বক, চোখ এবং চুলের গঠনে সাহায্য করে 
  • হাড় এবং দাঁত মজবুত করে
  • সুস্থ নার্ভ ফাংশন বজায় রাখে
  • শক্তি উত্পাদনে সাহায্য করে
  • এন্টি-ইনফ্লামেটরি হিসেবে কাজ করে
  • রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়
  • রক্ত জমাট বাঁধতে সহায়তা করে
  • ক্যালসিয়াম এবং ফসফরাস এর শোষণকে সহজতর করে
  • কোষের বৃদ্ধি এবং বিভাজন নিয়ন্ত্রণ করে

এটির অভাবজনিত জনিত সমস্যা:

ভিটামিন গ্রহণে ভারসাম্যহীনতা বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ হতে পারে, যার মধ্যে রয়েছে:

দুর্বল ইমিউন সিস্টেম: বিভিন্ন খাদ্যপ্রাণ সরাসরি আমাদের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থার উপরে কাজ করে। এদের ঘাটতি দুর্বল ইমিউন সিস্টেমের দিকে পরিচালিত করতে পারে, যা শরীরকে সংক্রমণ এবং অসুস্থতার জন্য সংবেদনশীল করে তোলে।

ত্বকের সমস্যা: এই পুষ্টিউপাদান সমূহের অভাব ত্বকের শুষ্কতা, ব্রণ এবং সোরিয়াসিসের মতো সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।

দুর্বল হাড়: ভিটামিন ডি-এর অভাব হাড়কে দুর্বল করতে পারে, অস্টিওপোরোসিস এবং অন্যান্য হাড়-সম্পর্কিত সমস্যা সৃষ্টি করে।

ক্লান্তি এবং দুর্বলতা: বি কমপ্লেক্স এর ঘাটতি বাহু ও পায়ে ক্লান্তি, দুর্বলতা এবং অসাড়তা সৃষ্টি করতে পারে।

দুর্বল রক্ত ​​​​জমাট বাঁধা: ভিটামিন কে এর ঘাটতি হলে রক্ত ​​​​জমাট বাঁধতে পারে না। অনিয়ন্ত্রিত রক্তপাত এবং ক্ষত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়।

ভিটামিন ও মিনারেল এর ভিতরে পার্থক্য (Vitamin vs Mineral)

এই দুইটি পুষ্টি উপাদানকে একটি অন্যটির সম্পুরক ধরা হলেও এবং এদেরকে প্রায় সময়ই এক সাথে উল্লেখ করা হলেও এদের মাঝে অনেক পার্থক্য রয়েছে। নিচে তালিকাকারে এদের পার্থক্য দেওয়া হলো: 

নং বৈশিষ্ট্য ভিটামিন মিনারেল
1 সংজ্ঞা জৈব যৌগ যা স্বাভাবিক শারীরিক ক্রিয়াকলাপের জন্য অল্প পরিমাণে প্রয়োজন অজৈব উপাদান যা স্বাভাবিক শারীরিক ক্রিয়াকলাপের জন্য অল্প পরিমাণে প্রয়োজন। 
2 উৎস সাধারণত খাদ্য থেকে পাওয়া যায়, তবে কিছু শরীর দ্বারা উত্পাদিত হতে পারে সাধারণত খাদ্য বা সম্পূরক থেকে প্রাপ্ত
3 গঠন কার্বন, হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেনের সমন্বয়ে গঠিত যৌগ একক উপাদান।
মুলত মৌলিক পদার্থ
4 কাজ বৃদ্ধি, মেটাবলিজম এবং রোগ প্রতিরোধ সহ বিভিন্ন শারীরিক ক্রিয়াকলাপে অংশগ্রহণ করুন শক্তিশালী হাড় এবং দাঁত তৈরি করা, স্নায়ু সংকেত প্রেরণ করা এবং তরলের ভারসাম্য বজায় রাখা সহ বিভিন্ন শারীরিক ক্রিয়াকলাপে অংশগ্রহণ করুন
5 দৈনিক প্রয়োজন অল্প পরিমাণে প্রয়োজন, সাধারণত মাইক্রোগ্রাম বা মিলিগ্রামে অল্প পরিমাণে প্রয়োজন, সাধারণত মিলিগ্রাম বা গ্রাম। অতিরিক্ত পরিমাণ অনেক সময় প্রস্রাবের সাথে নিষ্কাসিত হয়। 
6 প্রকার জলে দ্রবণীয় (ভিটামিন বি এবং সি) এবং চর্বি-দ্রবণীয় ( এ, ডি, ই, এবং কে) Essental Mineral (ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, ম্যাগনেসিয়াম, সোডিয়াম, পটাসিয়াম, ক্লোরাইড এবং সালফার) এবং Trace Mineral (লোহা, জিংক, কপার, ম্যাঙ্গানিজ, আয়োডিন, সেলেনিয়াম এবং ফ্লোরাইড)
7 অভাবজনিত শারীরিক সমস্যা ত্বকের ব্যাধি, দুর্বল ইমিউন সিস্টেম এবং রাতকানা রোগ সহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা হতে পারে অস্টিওপোরোসিস, রক্তাস্বল্পতা এবং অনিয়মিত হৃদস্পন্দন সহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা হতে পারে
8 বিষাক্ততা চর্বি-দ্রবণীয় খাদ্যপ্রাণের অতিরিক্ত গ্রহণ বিষাক্ততার দিকে পরিচালিত করতে পারে অতিরিক্ত গ্রহণের ফলে বিষাক্ততা হতে পারে, যা বমি বমি ভাব, বমি, বিভিন্ন অঙ্গের নিষ্ক্রিয়তা সহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে
  উদাহরন ভিটামিন সি,বি কমপ্লেক্স, ডি, ই, কে ইত্যাদি ক্যালসিয়াম, আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম, সোডিয়াম, পটাসিয়াম, জিঙ্ক

আমাদের খাদ্যের অপরিসীম উপাদানের একটি হলো Vitamin। এমন আরো একটি উপাদান হলো মিনারেলস। একই সাথে ভিটামিন আর মিনারেলস আমাদের শরীরের ভিতরের নানা রকমের কাজে সহয়তা করে থাকে।

সাধারণত আমাদের প্রতিদিনকার খাবারই এদের মূল উৎস, একই ভাবে এদের অভাবে আমাদের শরীরও অসুস্থ হয়ে পড়ে।