আমাদের প্রতিদিনের খাবারের একটি বড় অংশ শর্করা বা কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার। আমাদের শরীরে প্রয়োজনীয় শক্তি সরবরাহ এবং শরীরবৃত্তীয় কাজের পরিচালনাতে এই ধরণের খাদ্য গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পালন করে।
কার্বোহাইড্রেট কি?
কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা হলো কার্বন, অক্সিজেন ও হাইড্রোজেন দ্বারা তৈরি এমন একটি জৈবযোগ্য যা আমাদের শরীরে শক্তি উৎপাদন করে ও ভবিষ্যতে ব্যবহারের জন্য চর্বি আকারে জমা থাকে এবং শরীরে নানাবিধ গঠনমুলক কাজে অংশগ্রহণ করে।
আমাদের শরীরে পুষ্টির সাথে সম্পর্কিত মূল ৭টি পুষ্টি উপাদানের একটি হলো শর্করা। শর্করা আমাদের শরীরকে প্রয়োজনীয় শক্তি সরবরাহ করে এবং অতিরিক্ত পরিমাণে উপস্থিত থাকলে তা শরীর ফ্যাট বা চর্বি হিসেবে জমিয়ে রাখে। শরীরে শর্করার ভাঙ্গণে নানা রকম ক্ষুদ্রতম সুগার অণুতে বিভক্ত হয়। এবং পর্যায়ক্রমে ক্ষুদ্রতম অংশে এসে উপণিত হলে তা শরীরের নানা স্থানে শোষিত হয়।
কার্বোহাইড্রেটের প্রকারভেদঃ
সাধারণত তিন রকমের কার্বোহাইড্রেট আছে।
- মনোস্যাকারাইড - ক্ষুদ্রতম শর্করা অনু। যেমনঃ Glucose, Fructose, ল্যাকটোজ
- ডাইস্যাকারাইড - দুইটি ক্ষুদ্রতম অনু মিলে নতুন বৃহত্তর অনু তৈরি করে। যেমনঃ সুক্রোজ
- পলিস্যাকারাইড - দুইয়ের বেশি মনোস্যাকারাইড ও ডাইস্যাকারাইড মিলে তৈরি হয়। যেমনঃ স্টার্চ
আমাদের শরীরে প্রয়োজনীয় পুষ্টিপাদানের মাঝে অন্যতম ডায়েটারি ফাইবারও একধরণের কার্বোহাইড্রেট, কিন্তু এর গাঠনিক বৈশিষ্ট্য এবং কাজের ধরণ আলাদা হওয়ার কারণে একে আলাদা পুষ্টিপাদানের মর্যাদা দেওয়া হয়।
এছাড়াও উদ্ভিদের গাঠনিক উপাদান সেলুলোজও একধরণের কার্বোহাইড্রেট। মানুষ এই ধরণের শর্করা হজম করতে পারে না। তৃণভোজী প্রাণিদের শরীরে সেলোলোজ হজমকারী এনজাইম রয়েছে। নানা রকম অর্থনৈতিক কাজে যেমনঃ ফাইবার তৈরিতে সেলুলোজ ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
কার্বোহাইড্রেট এর উৎস:
কার্বোহাইড্রেটের বিভিন্ন ধরণের উৎস রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে:
- শস্য - চাল, গম, ওটস, যব,ভুট্টা।
- ফল - কলা, আপেল, আঙ্গুর, কমলা, তরমুজ,স্ট্রবেরি।
- সবজি - আলু, মিষ্টি আলু, মটর, ভুট্টা, গাজর,ব্রোকলি।
- লেগুম জাতীয় খাবার - মটরশুটি, মসুর ডাল, ছোলা, চিনাবাদাম।
- দুগ্ধজাত পণ্য - দুধ, দই এবং পনির।
- চিনি জাতীয় খাবার - টেবিল চিনি, মধু, ম্যাপেল সিরাপ এবং কর্ন সিরাপ।
- প্রক্রিয়াজাত খাবার - রুটি, পাস্তা, স্ন্যাক বার, মিষ্টি।
এটা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে কার্বোহাইড্রেটের সমস্ত উৎস পুষ্টির মূল্যের ক্ষেত্রে সমান নয়। হোল গ্রেইন, ফল, শাকসবজি এবং শিম জাতীয় খাবারকে সাধারণত কার্বোহাইড্রেটের স্বাস্থ্যকর উৎস হিসাবে বিবেচনা করা হয়, কারণ এতে প্রচুর ফাইবার, ভিটামিন এবং মিনারেল রয়েছে। অন্যদিকে, প্রক্রিয়াজাত খাবার এবং চিনিযুক্ত খাবারে প্রায়শই ক্যালরি বেশি থাকে এবং পুষ্টির পরিমাণ কম থাকে। এই কারণে এগুলো পরিমিত পরিমাণে খাওয়া উচিত।
শর্করা পরিপাকঃ
আমাদের শরীরে নানা রকমের এনজাইম বা উৎসেচক আছে যারা শর্করা এর ভাঙ্গণে সাহায্য করে থাকে। নির্দিষ্ট এনজাইম নির্দিষ্ট ধরণের শর্করার ভাঙ্গণে সাহায্য করে।
- ইনসুলিন - Glucose এর রেগুলেশনে সাহায্য করে।
- ল্যাকটেজ - ল্যাকটোজের ভাঙ্গণে সাহায্য করে। ল্যাকটোজকে ভেঙ্গে Glucose আর গ্যালাকটোজে পরিণত হয়।
- সুক্রেজ - সুক্রোজকে ভেঙ্গে Glucose এ পরিণত করে।
কার্বোহাইড্রেটের কাজঃ
শর্করা আমাদের শরীরে কি ধরনের কাজ করে থাকে যা গুণে শেষ করা যাবে না। নিচে এর কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ দেওয়া হলো:
- কার্বোহাইড্রেট আমাদের শরীরকে শক্তি দেয়।
- এটি আমাদের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি জমা করে রাখে
- আমাদের পেশীর পরিমাণ ঠিক রাখতে সাহায্য করে এবং এর রক্ষণাবেক্ষণ করে।
- স্টার্চ জাতীয় খাদ্যে অনেক ডায়েটারি ফাইবার আছে। এগুলো আমাদের অন্ত্রের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করে
- Glucose শরীরে দ্রুত মিশে শরীরকে শক্তি জোগায়
- আমাদের মস্তিস্ক এক্সক্লুসিভভাবে Glucose থেকে শক্তিগ্রহণ করে সচল থাকে।
শর্করার আধিক্যজনিত সমস্যাসমুহঃ
কার্বোহাইড্রেট এর পরিমাণ অতিরিক্ত হয়ে গেলে নানা রকমের শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। নিচে কিছু উল্লেখ করা হলো:
- ওজন বাড়িয়ে দেয়।
- আর্থ্রাইটিসের ঝুকি বেড়ে যায়।
- শরীরে অতিরিক্ত চর্বি জমা শুরু করে।
- টাইপ ২ ডায়াবেটিস এর ঝুকি বেড়ে যায়।
- হৃদরোগের অন্যতম কারন হলো শর্করা জাতীয় খাদ্য।
- ক্যান্সার ও টিউমার সেল ডেভলপমেন্ট ও এদের বেড়ে চলার পেছনে এই পুষ্টি উপাদানের বড় ভূমিকা আছে।
- মহিলাদের ব্যাকটেরিয়াল ভেজাইনোসিস নামক সমস্যার জন্য শর্করা অনেকাংশে দায়ী।
- কার্বোহাইড্রেট ও ইনসুলিন রেসিস্টেন্সঃ কার্বোহাইড্রেট এর পরিমাণ বেড়ে গেলে শরীর একটানা ইনসুলিন তৈরি করেই যেতে থাকে। তখন ইনসুলিন রেসিস্টেন্স নামক সমস্যা তৈরি হতে পারে।
সাম্প্রতিক সময়ে কার্বোহাইড্রেট থেকে নজর সরিয়ে নানা রকমের লো-কার্ব ডায়েট জনপ্রিয় হচ্ছে। মুলত সুস্থ থাকা, ওজন কমানো এই ধরণের বিষয়গুলোই এখানে অনেক প্রাধান্য পাচ্ছে। আমরা সেই সব ডায়েট প্ল্যান মেনে চলি আর নাই বা চলি তা আমাদের ব্যাপার। কিন্তু একটা ব্যাপার আমাদের সুস্থ থাকতে মানতেই হবে, আর তা হলো অতিরিক্ত শর্করা আমাদের শরীরের জন্য ক্ষতিকর।
তাই আমাদের উচিৎ অতিরিক্ত শর্করা গ্রহণ থেকে বিরত থাকা, অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের সাথে একটা প্রয়োজনীয় সমন্বয় নিয়ে আসা। এতে করে আমরা যেমন অনেক শারীরিক সমস্যা থেকে দূরে থাকবো, ঠিক একই সাথে আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যও ভালো থাকবে। কথায় বলে, "সুস্থ শরীর, সুখী জীবন।"