এনজাইম বা Enzyme কি? এনজাইমের কাজ, প্রকারভেদ, আধিক্য ও অভাবজনিত সমস্যা

এনজাইম ও কো-এনজাইম নানা রকম শরীরবৃত্তীয় কাজ করার মাধ্যমে আমাদের সুস্থ রাখে। এগুলো বিভিন্ন অঙ্গ থেকে উৎপন্ন হয়। প্রোটিন জাতীয় এই পদার্থগুলো জীবন ধারণের জন্য অপরিহার্য। 

এনজাইম বা Enzyme বলতে কি বুঝায়?

এনজাইম বা উৎসেচক হলো এমন একটি জৈব রাসায়নিক পদার্থ যা জীবদেহের অভ্যন্তরে নির্দিষ্ট বিক্রিয়ায় প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। বিক্রিয়া শেষে এই সকল পদার্থ নিঃশোষিত হয় না। এরা তার আগের অবস্থায় ফেরত যায়, অর্থাৎ এরা পরবর্তী বিক্রিয়ার জন্য প্রস্তুত হয়। একটি নির্দিষ্ট Enzyme  একটি নির্দিষ্ট বিক্রিয়াতেই সাহায্য করতে পারে। গাঠনিক দিক থেকে এরা মূলতঃ প্রোটিন। Enzyme এর অপর নাম হলো উৎসেচক বা জৈব অনুঘটক।

উদাহরণ: এমাইলেজ, লাইপেজ, ট্রিপসিন, টায়ালিন ইত্যাদি।

উৎপত্তিস্থল: Enzyme  নানা রকমের কোষ কিংবা টিস্যু থেকে উৎপন্ন হতে পারে। কিছু বহিঃক্ষরা গ্রন্থিও এদের নিঃস্বরন করে থাকে। যেমনঃ আইলেটস অব ল্যাংগারহ্যান্স। পরিপাকের সাথে সম্পর্কিত উৎসেচক তৈরি হয় পাকস্থলি ও ক্ষুদ্রান্তে এবং শক্তি উৎপাদনের সাথে সম্পর্কিত Enzyme গুলো তৈরি হয় মাইটোকন্ড্রিয়ায়। 

এটি কীভাবে কাজ করে?

আমরা জানি, কোনো একটি বিক্রিয়া হতে হলে সক্রিয়তাকরণ শক্তি (Activation Energy) প্রয়োজন হয়। এই শক্তি অর্জিত হলে অনুগুলোর বন্ধনে ভাঙ্গন তৈরি হয়। Enzyme এর কাজ হলো সেই প্রয়োজনীয় শক্তির মাত্রাকে কমিয়ে নিয়ে আসা। যার ফলে বিক্রিয়া করতে কম শক্তির প্রয়োজন হয়। এর ফলে খুব দ্রুত বিক্রিয়া হতে পারে। 

উৎসেচক এই প্রয়োজনীয় শক্তির পরিমান কমানোর জন্য বিক্রিয়ার জন্য একটি বিকল্প পথ চালু করে। এই বিকল্প পথে সক্রিয়াকরণ শক্তি সাধারণ অবস্থা থেকে কম থাকে। যার ফলে সহজেই বিক্রিয়া সংঘটিত হয়। 

                       

Enzyme এর প্রকারভেদ (Types of Enzyme):

 Enzyme কে বিভিন্ন প্রকারে ভাগ করা যায়। নিচে গুরুত্বপুর্ন চারটি প্রকারের উল্লেখ করা হলো:  

  1. অক্সিডো-রিডাকেটেজ
  2. ট্রান্সফারেজ
  3. লাইগেজ
  4. হাইড্রোলেজ

১. অক্সিডো-রিডাকেটেজ: 

এই ধরণের অনুঘটক বিভিন্ন অনুর সাথে ইলেক্ট্রন আদান প্রদান করে জারন-বিজারন বিক্রিয়া সংঘটিত করে। যেমন: ল্যাকটিক ডিহাইড্রোজিনেজ পাইরুভিক এসিডকে বিজারিত করে ল্যাকটিক এসিডে পরিণত করে। 

 ২. ট্রান্সফারেজ: 

এই ধরণের অনুঘটক এক পদার্থ থেকে অন্য পদার্থে যৌগমুলককে স্থানান্তরিত করতে পারে। যেমন: এলানিন ট্রান্সফারেজ এলানিন থেকে এমাইনো গ্রুপকে স্থানান্তরিত করতে পারে। 

 ৩. লাইগেজ: 

এটি দুইটি আলাদা অনুর মাঝে সংযোগ তৈরি করে। যেমনঃ DNA - লাইগেজ। 

 ৪. হাইড্রোলেজ: 

এই ধরণের উৎসেচক পানির উপস্থিতিতে বড় অনুকে ভেঙ্গে সরল পদার্থে পরিণত করে। যেমন: পেপসিনোজেন প্রোটিনকে ভেঙ্গে পেপসিনে পরিণত করে। একই ভাবে এমাইলেজে কার্বোহাইড্রেটের ভাঙনে এবং লাইপেজ স্নেহ জাতীয় খাবারের ভাঙ্গনে সাহায্য করে।

এছাড়াও নানা রকমের উৎসেচক আছে। প্রকার অনুযায়ী এদের কাজেও বৈচিত্র্য রয়েছে। 

এনজাইমের কাজ:

আমাদের শরীরে উৎসেচকের কাজ গুনে শেষ করা যাবে না। এদের কাজের ব্যাপকতা এতটাই বেশি যে আমরা সেই কাজের সিকি পরিমাণও জানতে পেরেছি কিনা এ নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়।

নিচে উৎসেচক এর খুবই গুরুত্বপুর্ণ ৪টি কাজ খাদ্য পরিপাক, শক্তি উৎপাদন, DNA রেপ্লিকেশন, হরমোন তৈরি নিয়ে আলোচনা দেওয়া হলো:

খাদ্য পরিপাকে:

আমাদের শরীরে প্রতিটি খাদ্য উপাদান পরিপাকে আলাদা আলাদা উৎসেচক কাজ করে। যেমনঃ ল্যাকটোজকে ল্যাকটেজ Enzyme  ভাঙতে সাহায্য করে একে গ্যালাক্টোজ ও গ্লুকোজে পরিণত করে। 

শক্তি উৎপাদন:

আমাদের শরীরে শক্তি উৎপাদনের জন্য ATP  তৈরি করতে হয়। ATP আমাদের শরীরে শক্তি হিসেবে ব্যয় হয়। ATP synthase এর ক্রিয়ায় ATP তৈরি হয়। 

DNA রেপ্লিকেশন:

আমাদের শরীরে কোষের বৃদ্ধির জন্য DNA রেপ্লিকেশন খুবই গুরুত্বপুর্ণ ধাপ। DNA পলিমারেজ এই গুরুত্বপুর্ণ কাজে সাহায্য করে থাকে। 

হরমোন তৈরিতে:

নানা রকমের Enzyme হরমোন তৈরিতেও সাহায্য করে থাকে। যেমনঃ গ্লুকোকাইনেজ  নামের উৎসেচক এর ক্রিয়ায় ইনসুলিন তৈরি হয় যা গ্লুকোজের ভাঙ্গনে সাহায্য করে থাকে। 

Enzyme এর আধিক্যজনিত সমস্যা:

অতিরিক্ত উৎসেচকের উৎপাদন আমাদের নানা রকমের সমস্যার দিকে নিয়ে যেতে পারে। নিম্নে কিছু সমস্যার কথা দেওয়া হলো: 

  1. প্যানক্রিয়াইটিস:
    প্যানক্রিয়াস বা অগ্নাশয় আমাদের শরীরে নানা রকমের পরিপাকের কাজে নিয়োজিত উৎসেচক তৈরি করে থাকে। যদি এই সকল পদার্থ অতিরিক্ত পরিমাণে তৈরি হতে থাকে তবে এরা অগ্নাশয়কেই হজম করা শুরু করে দেয়। এই পরিস্থিতিকে প্যানক্রিয়াইটিস বলে। 
  2.  Inflammatory Bowel Diseases/IBD:
    অতিরিক্ত হজমকারি উৎসেচক তৈরি হলে এরা আমাদের খাদ্যনালিকেও হজম করা শুরু করতে পারে। এই পরিস্থিতিকে বলে ইনফ্লামেটরি বাউল ডিজিস। 
  3. লিভার এর ক্ষয়:
    আমাদের শরীরে তৈরি হওয়া নানা রকমের রাসায়নিক পদার্থ, টক্সিন, ঔষধ নিষ্কাশনের জন্য লিভার নানা রকমের উৎসেচক তৈরি করে থাকে। এই সকল পদার্থ অতিরিক্ত তৈরি হলে লিভারের ক্ষতি হতে পারে। এমনকি আমাদের যকৃত নিষ্ক্রিয়ও হয়ে যেতে পারে। 
  4. অক্সিডেটিভ স্ট্রেস:
    শক্তি উৎপাদনের সাথে নিয়োজিত Enzyme এর আধিক্যে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস তৈরি হয় এবং কোষের ক্ষতি হয়। 

এর অভাবজনিত সমস্যা:

যেহেতু Enzyme নানা রকমের কাজ করে থাকে সেহেতু এর অভাব তৈরি হলে নানা রকম শরীরবৃত্তীয় কাজ বাধাপ্রাপ্ত হবে। এমন কিছু সমস্যার মাঝে রয়েছে: 

  1.  ল্যাকটেজের অভাবে: এই Enzyme এর অভাবে মানুষ ল্যাকটোজ জাতীয় খাবার হজম করতে পারে না। এই পরিস্থিতি অনেক সময় “ল্যাকটোজেন ইনটোলারেন্স” এর দিকে ধাবিত হতে পারে। 
  2.  প্রোটিয়েজের অভাব: প্রোটিয়েজ প্রোটিনের ভাঙনের জন্য দায়ী। এর অভাবে আমাদের শরীর প্রোটিন ঠিক মতো পরিপাক করতে পারে না। 
  3.  এমাইলেজের অভাবে: এমাইলেজের অভাবে আমাদের শরীর শর্করা জাতীয় খাবার ভাঙতে পারে না । 
  4.  ইনসুলিনের অভাব: ইনসুলিনের অভাব ডায়াবেটিসে রূপ নিতে পারে। 

Enzyme এর মাত্রা ঠিক রাখতে যেসকল খাবার খাওয়া উচিৎ:

আমাদের খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের শরীরে আমাদের জৈব রাসায়নিক পদার্থগুলোর সাম্যতা কতটুকু রক্ষা হচ্ছে। Enzyme ও এর বিকল্প না। নিচে এমন কিছু খাবারের কথা উল্লেখ করা হলো যা আমাদের শরীরে উৎসেচক এর মাত্রাকে ঠিক রাখতে সাহায্য করতে পারে।

ফল:  এগুলোতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ও মিনারেল রয়েছে যা আমাদের শরীরে Enzyme  উৎপাদনে সাহায্য করে থাকে। যেমন:  কমলা, তরমুজ, আনার

সবুজ শাক: সবুজ শাকে ভিটামিনের পাশাপাশি প্রচুর এন্টি অক্সিডেন্ট থাকে। এগুলো সম্মিলিতভাবে Enzyme এর মাত্রা ঠিক রাখে। 

সহজপাচ্য আমিষ: যেসকল আমিষ সহজেই এমাইনো এসিডে পরিণত হতে পারে সেসকল আমিষ আমাদের শরীরের উৎসেচকের মাত্রা ঠিক রাখার জন্য উপকারি। যেমন: মাছ, মুরগীর মাংস, ডাল। 

ফার্মেন্টেটেড খাবার: ফার্মেন্টেটেড খাবারে প্রচুর পরিমাণে প্রো-বায়োটিক রয়েছে যা আমাদের ক্ষুদ্রান্ত্রের স্বাস্থ্য ভালো রাখে। উৎসেচক এর মাত্রাও এ কারণে ঠিক থাকে। যেমন: দই, কিফার, টফু। 

বাদাম ও নানা রকমের বীজ: এগুলো ভিটামিন ও মিনারেলে পরিপূর্ণ। যা উৎসেচকের সাম্যতা বজায় রাখতে সাহায্য করে। যেমন: চিনা বাদাম, কাজু বাদাম, সুর্যমুখীর বীজ ইত্যাদি। 

এনজাইম নিয়ে কিছু তথ্য: 

  • এনজাইম মূলতঃ প্রোটিন।
  • নির্দিষ্ট এনজাইম নির্দিষ্ট বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে। 
  • Enzyme এর অপর নাম হলো উৎসেচক। 
  • রাসায়নিক বিক্রিয়ায় ব্যবহৃত ক্যাটালিস্ট বা প্রভাবকের শরীরবৃত্তীয় প্রকরণ হলো এনজাইম।
  • কো-এনজাইম এক ধরণের জৈবযৌগ।  
  • কো-এনজাইম এনজাইমের সাথে যুক্ত হয়ে এনজাইমকে সক্রিয় করে। 
  • ধারনা করা হয়, আমাদের শরীরে ৩০০০ এরও বেশি ধরণের Enzyme এর রয়েছে।