আমাদের সামনে যখনই “স্নেহ জাতীয় খাবার” বা “ফ্যাট” শব্দটি চলে আসে তখনই আমাদের মনে হয় এই ধরণের খাবার হয়ত স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু ব্যাপারটি আসলে এমন না। এটি আমাদের শরীরের জন্য খুবই গুরুত্বপুর্ণ খাদ্যাপাদান। স্নেহ জাতীয় খাদ্য ছাড়া আমাদের টিকে থাকা দুস্কর এবং এই ধরণের খাবার পুরোপুরি বাদ দিয়ে দেওয়া ব্যবহারিকও নয়।
স্নেহ জাতীয় খাদ্য বা ফ্যাট বা চর্বি কি?
Fat বা স্নেহ জাতীয় খাদ্য আমাদের শরীরের একটি প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান যা অনেক দিন পর্যন্ত আমাদের শরীরে অবস্থান করে এবং প্রয়োজনের সময় পুষ্টির যোগান দেয়।
শরীরের অতিরিক্ত কার্বোহাইড্রেটও Fat হিসেবে জমা হতে পারে। তবে আমাদের শরীরে ফ্যাট জাতীয় খাবারের মূল উৎস হলো বিভিন্ন ধরণের খাবার।
চর্বি জাতীয় খাদ্যের প্রকারভেদ
ফ্যাটকে মোটাদাগে চার ভাগে ভাগ করা যায়:
- স্যাচুরেটেড ফ্যাট
- মনো আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট
- পলি আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট
- ট্রান্স ফ্যাট
স্যাচুরেটেড ফ্যাট:
স্যাচুরেটেড ফ্যাট শরীরের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। এটি কোলেস্টেরল বাড়াতে ভুমিকা রাখে। বিভিন্ন রকমের খাবারে এই ধরণের চর্বি দেখা যায়। যেমন: লাল মাংস, চিংড়ি, কলিজা প্রভৃতি।
মনো আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট
মনোস্যাচুরেটেড ফ্যাট হল এক ধরনের চর্বি। এটি স্বাস্থ্যকর চর্বিগুলির মধ্যে একটি। মনোস্যাচুরেটেড ফ্যাট কক্ষ তাপমাত্রায় তরল থাকে কিন্তু ঠান্ডা হলে শক্ত হতে শুরু করে। এতে একটি কার্বন বন্ধন থাকে।
পলি আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট:
পলি আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটও স্বাস্থ্যকর চর্বিগুলির মধ্যে একটি। পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট উদ্ভিদ এবং প্রাণীজ খাবারে পাওয়া যায়, যেমন স্যামন, উদ্ভিজ্জ তেল এবং কিছু বাদাম এবং বীজ। এতে কার্বন কার্বন দ্বিবন্ধন ও ত্রিবন্ধন দেখা যায়।
ট্রান্স ফ্যাট:
এটি একধরণের রুপান্তরিত চর্বি যা রান্নার প্রক্রিয়ায় তৈরি হয় বা কৃত্রিম উপায়ে প্রস্তুত করা হয়।
এছাড়া উপাদানের ধরণের উপরেও এই খাদ্য উপাদাঙ্কে ভাগ করা সম্ভবঃ
- ফ্যাটি এসিড
- লিপিড
- তেল
- প্রাণিজ চর্বি
- উদ্ভিজ্জ চর্বি
স্নেহ জাতীয় খাদ্যের পরিপাকঃ
চর্বি জাতীয় খাবার পরিপাকে যে এনজাইমটি মূল ভূমিকা রাখে তা হলো লাইপেজ। এই এনজাইমের প্রভাবে স্নেহ জাতীয় খাদ্য বা চর্বি জাতীয় খাবার ভেঙ্গে ক্ষুদ্র ফ্যাটি এসিড চেইনে পরিণত করে যা পরবর্তীতে আমাদের শরীর দ্বারা গৃহিত হয়।
ফ্যাটের কাজ
অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, আসলেও কি আমাদের শরীরে স্নেহ জাতীয় খাদ্য বা চর্বি জাতীয় খাদ্যের কোনো প্রয়োজন রয়েছে? আসলে এর প্রয়োজনীতা অনেক। Fat জাতীয় খাদ্য আমাদের শরীরকে শক্তি দেয়। শর্করার এভাবে এটি মূল শক্তির উৎস হিসাবেও কাজ করতে পারে। একই সাথে কোষের স্বাভাবিক কাজের জন্যও এটি গুরুত্বপূর্ণ। এরা আমাদের অনেক অভ্যন্তরীণ অঙ্গকে রক্ষা করে এবং শরীরকে শীতের সময় গরম রাখে। নানা রকমের হরমোন তৈরিতেও এর অবদান আছে।
আধিক্য জনিত সমস্যা
স্নেহ জাতীয় খাবার গ্রহণের পরিমান বেড়ে গেলে আমাদের শরীরে নানা রকমের সমস্যা হতে পারে। নিচে এমন কিছু সমস্যা উল্লেখ করা হলো:
- অত্যাধিক পরিমাণে ফ্যাট জাতীয় খাবার গ্রহণ ওজন বৃদ্ধির দিকে নিয়ে যেতে পারে। একই সাথে কার্বোহাইড্রেট ও ফ্যাট জাতীয় খাদ্যগ্রহণ ব্যাপারটিকে আরো খারাপের দিকে নিতে পারে।
- উচ্চ রক্ত চাপ ও হৃদরোগ।
- কোলেস্টেরল বৃদ্ধি।
- ইনসুলিন রেসিসটেন্স ও টাইপ-২ ডায়াবেটিস।
- ব্রেইন স্ট্রোক।
- ক্যান্সার ইত্যাদি।
স্বল্পতাজনিত সমস্যা
স্নেহ জাতীয় খাবার কম পরিমানে গ্রহণ করলেও নানা রকমের শারীরিক সমস্যা হতে পারে। নিচে তা দেওয়া হলো:
- ত্বকে খসখসে ভাব ও দাগ তৈরি
- ভিটামিন স্বল্পতা
- শারীরিক দূর্বলতা
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ঘাটতি
- নখ নিজে থেকেই খসে যাওয়া কিংবা ভেঙ্গে যাওয়া
- ক্ষত শুকাতে দেরি হয়, ইনফেকশনের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
- কোলেস্টেরল ট্রান্সপোর্টেশনে সমস্যা দেখা দেয়।
স্নেহ জাতীয় খাদ্য সমৃদ্ধ খাবার
স্নেহ জাতীয় খাবারের উৎসকে মূলত দুইভাগে ভাগ করা যায়ঃ
- প্রাণীজ এবং
- উদ্ভিজ্জ
প্রাণীর উৎস:
- মাংস (গরুর মাংস, ছাগলের মাংস, ভেড়ার মাংস)
- পল্ট্রি (মুরগি, টার্কি)
- মাছ (স্যামন, সুরমা, পাঙ্গাস)
- ডিম (মুরগির ডিম, হাসের ডিম)
- দুগ্ধজাত পণ্য (দুধ, পনির, মাখন)
উদ্ভিদ উৎস:
- বাদাম জাতীয় খাবার(কাজু বাদাম, আখরোট, চিনাবাদাম)
- বীজ জাতীয় খাবার (চিয়া সিড, তিসি, কুমড়োর বীজ, সয়াবিন)
- ফল: জলপাই, নারিকেল, অ্যাভোকাডো
- তেল: জলপাই তেল, সরিষা তেল, সয়াবিন তেল
- ফার্মেন্টেটেড খাবার (টোফু)
এছাড়া বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাতকৃত খাবার যেমনঃ মায়োনিজ, ফাস্টফুড যেমনঃ বার্গার ইত্যাদিতে প্রচুর ফ্যাট থাকে।
এটা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে সমস্ত চর্বি সমানভাবে তৈরি হয় না। বাদাম এবং বীজের মতো চর্বির কিছু উৎসে বেশিরভাগ স্বাস্থ্যকর আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকে। অন্যদিকে, প্রক্রিয়াজাত মাংসে অস্বাস্থ্যকর স্যাচুরেটেড এবং ট্রান্স ফ্যাট থাকে।
স্নেহ জাতীয় খাদ্যের লেভেল ঠিক রাখার উপায়
আমাদের শরীরে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ Fat থাকা আত্যাবশ্যক। একজন মহিলার জন্য এর পরিমাণ শরীরে মোট ওজনের ১০% থেকে ৩০% আর পুরুষদের জন্য এর পরিমাণ ৮% থেকে ১৯%। এই কারনেই আমাদের খাবারে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণে স্নেহ জাতীয় খাদ্য থাকা বাঞ্ছনীয়। যেভাবে আমাদের খাদ্যে ফ্যাটের পরিমাণ ঠিক রাখবোঃ
১। ক্যালোরির পরিমাণ পরিমাপ করে
২। যথাযথ নিউট্রিশন সম্পর্কে ধারণা থাকলে আমরা কোন কোন খাবারে Fat আছে জানতে পারবো এবং কতটুকু গ্রহণ করতে হবে তা বুঝতে পারবো
৩। শরীরের যেন অতিরিক্ত ফ্যাট জমতে না পারে সেজন্য ব্যায়াম করতে হবে, একই সাথে অতিরিক্ত ব্যায়াম শরীরের প্রয়োজনীয় Fatও ঝেরে ফেলতে পারে। সেজন্য জানতে হবে কতটুকু ব্যায়াম আমদের শরীরের উপযোগী।
৪। কার্ডিওভাস্কুলার ট্রেনিং কিংবা সংক্ষেপে কার্ডিও শরীরের মেটাবলিজমকে ত্বরাণ্বিত করতে এবং অতিরিক্ত ক্যালরি ঝেরে ফেলার জন্য খুবই দরকারি। যেমনঃ HIIT, HRT ইত্যাদি।
পরিশেষে, স্নেহ জাতীয় খাদ্য একটি অত্যাবশ্যকীয় খাদ্য উপাদান। একটি উপাদানকে পুরোপুরী সরিয়ে রেখে আমরা সুষম খাবার নিশ্চিত করতে পারি না। আর সুষম খাবার ব্যতীত আমাদের সুস্থ্য থাকাও অনেকটাই অসম্ভব না বলার অপেক্ষা রাখে না।