সকালে ঘুম থেকে উঠার পর এক কাপ চা পান না করলে আমাদের দিনই শুরু হয় না। বিভিন্ন রকমের চায়ের মাঝে গ্রিন টি একটি স্বাস্থ্যকর পানীয়। একে অনেক সময় বিশ্বের সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর পানীয় বলেও বিবেচনা করা হয়। আমাদের মনে প্রশ্ন জাগাটাই স্বাভাবিক যে “এই পানীয়তে এমন কি আছে?” যা একে এতটা অনন্য অসাধারণ করে তুলেছে। এই প্রশ্নটিরই উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে এখানে।
গ্রিন টি এর পুষ্টি উপাদান:
আমরা যদি Green Tea এর পুষ্টি উপাদানসমূহের দিকে লক্ষ্য করি তাহলে আমরা দেখতে পাবো প্রতি ৮ আউন্স গ্রিন টিতে রয়েছে (USDA অনুসারে):
- ক্যালোরি: ২.৪৫ কিলোজুল
- ফ্যাট, কার্বোহাইড্রেট: 0 গ্রাম
- প্রোটিন: ০.৫ গ্রাম
উপরের তালিকা থেকেই বোঝা যাচ্ছে গ্রিন টি অনেক অনেক পুষ্টি উপাদানের উৎস না। এটি গ্রহণে আমাদের শরীর অনেক ক্যালোরি লাভ করে এমনটাও না। একই সাথে এটিতে কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট ও প্রোটিন নেই বললেই চলে। এর কারণে এটি যে কোনো ধরণের ডায়েটের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।
একই সাথে, এর মাঝে কিছু এমন উপাদান রয়েছে যা এর উপকারিতা বাড়িয়ে তুলেছে। Pubmed এর Chinese Medicine নামের জার্নাল এর পর্যালোচনা অনুসারে গ্রিন টিতে বিভিন্ন এন্টিঅক্সিডেন্ট এবং ২৭ ধরনের মিনারেল রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে:
- পটাসিয়াম, যা আমাদের হাইড্রেটেড রাখতে সাহায্য করে
- ম্যাগনেসিয়াম, যা রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে
- সেলেনিয়াম, যা ইমিউন সিস্টেমকে সহায়তা প্রদান করে
এগুলোর পরিমাণ কম মনে হলেও, প্রতিদিন Green Tea গ্রহণ আমাদের শরীরে এই সকল মিনারেল এর অভাববোধ হতে দেয় না। একই সাথে এতে উপস্থিত এন্টি অক্সিডেন্ট সমূহেরও অনেক উপকারিতা রয়েছে।
গ্রিন টি এর উপকারিতা:
প্রাচীন চীন ও ভারতের মানুষরা রক্তপাত নিয়ন্ত্রণ এবং ক্ষত নিরাময়, হজমে সহায়তা, হৃদপিন্ড ও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতিতে এবং শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে Green Tea ব্যবহার করে আসছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে।
গবেষণায় দেখা গেছে যে গ্রিন টি ওজন হ্রাস, লিভারের ব্যাধি, টাইপ 2 ডায়াবেটিস, Alzheimer's Disease এবং আরও অনেক কিছুতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এই সকল উপকারিতার কারণে এই পানীয় সেবন উত্তোরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।
১. মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি:
আমরা সবাই জানি গ্রিন টিতে ক্যাফেইন রয়েছে। এই উপাদানটি অবসাদ ও ক্লান্তি কাটাতে, মানসিক অবস্থার উন্নতি করতে সাহায্য করে। একই সাথে গ্রিন টিতে ক্যাটাচিন রয়েছে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে ক্যাটাচিন,
- ফ্রি র্যাডিকেলের বিরুদ্ধে লড়াই করে,
- নিউরনকে (মস্তিষ্কের কোষ) ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া থেকে রক্ষা করে এবং
- সেল ডেথকে বিলম্বিত বা প্রতিরোধ করে।
- বিভিন্ন নিউরো-ডিজেনারেটিভ অসুখ যেমন ডিমেনশিয়া এবং পারকিনসন ডিজিজের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে
আমাদের অনেকেই হয়ত Green Tea এর কাপে চুমুক দেওয়ার পর এক ধরনের মানসিক প্রশান্তি অনুভব করেছি। এর কারণ লুকিয়ে আছে গ্রিন টি এর একটি পুষ্টি উপাদানে। এতে প্রাকৃতিক থায়ামিন রয়েছে যা মানবদেহের প্রয়োজনীয় ২০টি এমাইনো এসিডের একটি। থায়ামিনের কিছু স্বাস্থ্য উপকারের মাঝে রয়েছে:
- চাপ কমায়
- পেশিকে শিথীল করে
- ক্যাফেইন এর কারণে সৃষ্ট উদ্বেগের বিরুদ্ধে লড়াই করে
যদিও প্রায় সকল ধরনের চায়েই থায়ামিন রয়েছে কিন্তু Green Tea তে এর পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। এই উপাদানের আধিক্যই আমাদের মানসিক শান্তি প্রদান করে এবং মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়। একই সাথে মনোযোগ বৃদ্ধি, স্মৃতি সংরক্ষণ এর মতো গুরুত্বপুর্ণ কাজেও ভূমিকা রাখে এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়।
২. কার্ডিও-ভাস্কুলার সিস্টেমের সুস্থতা নিশ্চিতকরণে:
গবেষণায় দেখা গিয়েছে, যারা নিয়মিত গ্রিন টি সেবন করেন তাদের হৃদরোগ আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কম। একই সাথে এটি মানবদেহের মোট কোলেস্টেরল ও লো-ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন (LDL) বা "খারাপ" কোলেস্টেরলের পরিমাণ কমাতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।
একটি জরিপে দেখা গিয়েছে, স্বাস্থ্যকর খাবারের পাশাপাশি প্রতিদিন তিন থেকে পাঁচ কাপ Green Tea পান করলে কার্ডিওভাসকুলার রোগে মৃত্যুর ঝুঁকি ৪১% কমে আসে। আরোও একটি জরিপে দেখা গিয়েছে, নিয়মিত গ্রিন টি সেবনকারীদের মাঝে হৃদরোগে মৃত্যুর সম্ভাবনা ৩১% পর্যন্ত কমে আসে।
৩. টাইপ -২ ডায়াবেটিস প্রতিরোধে:
ডায়াবেটিস বর্তমান সময়ের একটি বড় ব্যাধি। পুরো বিশ্বের ৯.৩% মানুষ এই অসুখে আক্রান্ত। বাংলাদেশে এর পরিমাণ প্রায় ১৩.৭৫%। দিন দিন এর হার আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, যেসকল মানুষ Green Tea সেবনে অভ্যস্ত তাদের ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার হার কম।
গ্রিন টি প্রচুর পরিমাণে এন্টি অক্সিডেন্ট রয়েছে। এন্টি অক্সিডেন্ট মানবদেহে বিভিন্ন কাজ করতে পারে, যার মাঝে একটি হলো এটি ইনসুলিন রেসিসটেন্স কমাতে সাহায্য করে। এর ফলে কোষ ব্যবহারের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে গ্লুকোজ সরবরাহ নিশ্চিত হয় এবং রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় না।
৪. স্থূলতা ও ব্লাড সুগার কমাতে:
এমন খাবারের যদি তালিকা তৈরি করা হয় যা মানবদেহে ওজন কমাতে সাহায্য করে, তার মাঝে নিঃসন্দেহে Green Tea থাকবে। আমরা আগেই জেনেছি যে, গ্রিনটিতে ক্যাফেইন ও ক্যাটাচিন রয়েছে। এই দুইটি উপাদানই ওজন কমাতে সাহায্য করে। একই সাথে এই উপাদানগুলো রক্তে ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
এই উপাদানসমূহ মেটাবলিজমকে ত্বরান্বিত করতে এবং চর্বি পোড়াতে সাহায্য করে। ২৪০ জন মানুষের উপরে ১২ সপ্তাহ ব্যাপি একটি গবেষণা পরিচালনা করা হয়। এখানে দুইটি আলাদা ভাগে এই ২৪০ জনকে ভাগ করা হয়। এর একটি পক্ষকে Green Tea দেওয়া হয় যেখানে বাকিদের কোন কিছুই সেবন করা হয় নি। গবেষণা শেষে দেখা যায় যে যারা এই পানীয় সেবন করেছিলেন তাদের ওজন হ্রাস অন্য গ্রুপের তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণে হয়েছিলো।
৫. ইনফ্লামেশন কমাতে:
ইনফ্লামেশন আমাদের শরীরের একটি প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা। বিভিন্ন রোগ সম্পর্কে আমাদের সতর্ক করতে ইনফ্লামেশন দেখা দিতে পারে। কিন্তু আমাদের শরীরে এমন একটি উপাদান রয়েছে যা এই ইনফ্লামেশনকে ত্বরান্বিত করতে পারে। এই উপাদান টি ফ্রি র্যাডিকেল।
Green Tea তে প্রচুর পরিমাণে এন্টি অক্সিডেন্ট রয়েছে। এটি ফ্রি র্যাডিকেল এর সাথে যুক্ত হয়ে একে অকেজো করে দেয়, যার ফলে এটি আর ইনফ্লামেশন তৈরি করতে পারে না। এই প্রক্রিয়া সুস্থ ত্বক, সুন্দর চুল এর জন্যও গুরুত্বপুর্ণ।
৬. ক্যান্সার প্রতিরোধে:
গ্রিন টিতে প্রাপ্ত polyphenol সাময়িক সময়ের জন্য অতি বেগুনি রশ্মির বিকিরণ থেকে ত্বককে রক্ষা করতে ভূমিকা রাখতে পারে। এছাড়াও পলিফেনল আরোও বিভিন্ন রকমের ক্যান্সারের বিপক্ষে বিভিন্ন রকমের সুবিধা প্রদর্শন করে।
আমরা ইতিমধ্যে এন্টি অক্সিডেন্ট এর কথা জেনেছি। এই উপাদানটি ক্যান্সার প্রতিরোধেও ভূমিকা পালন করে। Green Tea সেবনে বিভিন্ন রকমের ক্যান্সার থেকে আমরা সুরক্ষা পেতে পারি। অন্তত বিভিন্ন গবেষণা তারই প্রমাণ বহন করে। এই সকল ক্যান্সারের মাঝে রয়েছে:
- স্তন ক্যান্সার
- মূত্রাশয় এর ক্যান্সার
- ডিম্বাশয়ের ক্যান্সার
- কোলোরেক্টাল (অন্ত্র) ক্যান্সার
- খাদ্যনালির (গলা) ক্যান্সার
- ফুসফুসের ক্যান্সার
- প্রোস্টেট ক্যান্সার
- স্কিন ক্যান্সার
৭. হাড়ের সুস্থতায়:
আমাদের মাঝে এমন অনেকেই আছি যারা হাটুর সমস্যায় ভুগছি দীর্ঘদিন ধরে। অনেকের জন্য আর্থ্রাইটিস এর কারণে স্বাভাবিক চলাচল করাই কষ্টকর। কিন্তু হাড়ের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে যে পানীয়টি আমাদের অসামান্য উপকার করতে পারে তা হলো Green Tea.
একই সাথে এই পানীয় হাড়ের ঘনত্ব ঠিক রাখতে সাহায্য করে। হাড়ের ঘনত্ব কমে গেলে অস্টিওপোরেসিস এর ঝুঁকি বৃদ্ধি পায় এবং হাড় ভঙ্গুর হয়ে যায়। একই সাথে নিয়মিত গ্রিন টি সেবন হাড় ও মাংস পেশির ব্যথা কমাতে ভূমিকা রাখে বলে ধারণা করা হয়।
গ্রিন টি এর উপকারিতা বা স্বাস্থ্যঝুঁকি:
গ্রিন টি এর উপকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। বিভিন্ন গবেষণা দৈনিক ৮ কাপ পরিমাণ Green Tea পান করার অনুমতি প্রদান করে। তবে এমন মানুষও খুঁজে পাওয়া সম্ভব যারা এর থেকে বেশি চা সেবন করে থাকে। মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে গ্রহণ করা হলে এই স্বাস্থ্যকর পানীয়টিও বিভিন্ন স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে। সম্ভাব্য স্বাস্থ্যঝুঁকির মাঝে রয়েছে:
- চঞ্চলতা বা অস্থিরতা
- অনিদ্রা
- মাথাব্যথা
- মাথা ঘোরা
- হৃৎস্পন্দন বেড়ে যাওয়া
- পানিশূন্যতা
- ঘন ঘন মূত্রত্যাগ
তবে কারো কারো ক্ষেত্রে এই সমস্যা আরো গুরুতর রূপ নিতে পারে। এই সকল সমস্যার মাঝে রয়েছে:
- ক্যাফেইন সংবেদনশীলতা:
এমন অনেকেই রয়েছে যাদের ক্যাফেইন সেন্সিটিভিটি রয়েছে। গুরুতর ক্যাফেইন সংবেদনশীলতাযুক্ত ব্যক্তিদের গ্রিন টি পান করার পরে অনিদ্রা, উদ্বেগ, বিরক্তি, বমি বমি ভাব বা পেট খারাপ হতে পারে।
- লিভারের ক্ষতি:
Green Tea অনেক বেশি পরিমাণে গ্রহণ করা হলে বিরল ক্ষেত্রে লিভারের ক্ষতি করতে পারে।
- উদ্দীপক ঔষধের এর সাথে বিক্রিয়া:
যদি একজন ব্যক্তি উদ্দীপক ওষুধের পাশাপাশি গ্রিন টি পান করেন, তবে এটি তাদের রক্তচাপ এবং হৃৎস্পন্দন বৃদ্ধির মতো সমস্যা হতে পারে।
যদিও Green Tea সাধারণত গর্ভাবস্থায় সেবনের জন্য নিরাপদ বলে মনে করা হয়, তবে এটি গ্রহণকে মাঝারি মাত্রায় সীমিত করার পরামর্শ দেওয়া হয়। ব্যক্তিগত নির্দেশনার জন্য একজন স্বাস্থ্যসেবা পেশাদারের সাথে পরামর্শ করা উত্তম। স্তন্যপান করানোর সময় গ্রিন টির পরিমিত ব্যবহার সাধারণত নিরাপদ। তবে অতিরিক্ত ক্যাফেইন গ্রহণ শিশুকে প্রভাবিত করতে পারে।
Green Tea সাধারণত প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য নিরাপদ বলে মনে করা হয়। তবে শিশুদের ক্ষেত্রে সীমিত পরিসরে গ্রিন টি সেবন করতে বলা হয় এবং সম্ভব হলে এড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়। চা এ ক্যাফেইন থাকে যা তাদের শারীরিক প্রভাব ফেলতে পারে এবং স্লিপ সাইকেলকে প্রভাবিত করতে পারে।