রসুনের উপকারিতা ও পুষ্টিতথ্য

হাজার হাজার বছর ধরে, রসুনকে মানুষ খাবারের স্বাদ বৃদ্ধির উপকরন হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। মশলা হিসেবে ব্যবহার করার আগে এটি প্রাচীন সংস্কৃতিতে বিভিন্ন চিকিৎসায় ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হত। চীনা, মিশরীয় এবং রোমান সভ্যতা রসুনের এই স্বাস্থ্য উপকারীতার কথা জানতো এবং ব্যবহার করত। আধুনিক স্বাস্থ্য বিজ্ঞানও এর উপকারিতা স্বীকার করে। স্বাস্থ্য সচেতন মানুষের মাঝে এই মশলার ব্যবহারও বৃদ্ধি পেয়েছে উল্লেখযোগ্য পরিমানে।

রসুনের পুষ্টিতথ্য: 

রসুনের পুষ্টিগুণ বলে শেষ করা যাবে না। এই মশলাটি বিভিন্ন রকমের ভিটামিনমিনারেলের ভান্ডার। নিয়মিত রসুন গ্রহণ করলে মানবদেহের প্রয়োজনীয় মিনারেল এবং ভিটামিনের ঘাটতি হ্রাস পায়।

নিচে রসুনের পুষ্টিগুণ ও পুষ্টিতথ্যের একটি তালিকা দেওয়া হলো: 

রসুনের পুষ্টিতথ্য (১০০ গ্রাম)
শক্তি ৬২৩ কিলো জুল (১৪৯ কিলো ক্যালোরিl)
শর্করা ৩৩.০৬ গ্রাম
ডায়েটারি ফাইবার ২.১ গ্রাম
ফ্যাট ০.৫ গ্রাম
প্রোটিন ৬.৩৬ গ্রাম
পানি ৫৯ গ্রাম
ভিটামিন পরিমাণ (দৈনিক চাহিদার শতকরা যোগান)
থায়ামিন (বি১) ০.২ মিগ্রা (১৭%)
রিবোফ্লাভিন (বি২) ০.১১ মিগ্রা (৯%)
নিয়াসিন (বি৩) ০.৭ মিগ্রা (৫%)
প্যান্টোথেনিক এসিড (বি৫) ০.৫৯৬ মিগ্রা (১২%)
ভিটামিন বি৬ ১.২৩৫০ মিগ্রা (৯৫%)
ফলেট ৩ মাইক্রো গ্রাম (১%)
কোলিন ২৩.২ মিগ্রা (৫%)
ভিটামিন সি ৩১.২ মিগ্রা (৩৮%)
মিনারেল পরিমাণ (দৈনিক চাহিদার শতকরা যোগান)
ক্যালসিয়াম ১৮১ মিগ্রা (১৮%)
আয়রন ১.৭ মিগ্রা (১৩%)
ম্যাগনেসিয়াম ২৫ মিগ্রা (৭%)
ম্যাঙ্গানিজ ১.৬৭২ মিগ্রা (৮০%)
ফসফরাস ১৫৩ মিগ্রা (২২%)
পটাসিয়াম ৪০১ মিগ্রা (৯%)
সোডিয়াম ১৭ মিগ্রা (১%)
জিঙ্ক ১.১৬ মিগ্রা (১২%)
সেলেনিয়াম ১৪.২ মাইক্রো গ্রাম (২৩%)
সালফার ৬৪ মিগ্রা (৭.৫%)

উপরের তালিকা থেকে একটি বিষয় প্রতীয়মান যে, ভিটামিন বি৬, ম্যাঙ্গানিজ, ফসফরাস ও সেলেনিয়ামের ঘটতি লাঘবে এটি বড় ভূমিকা রাখতে পারে। একই সাথে এতে অধিক পরিমাণে কার্বোহাইড্রেট ও ফ্যাট নেই। এই কারনে এই মশলা বিভিন্ন ডায়েট প্ল্যান এর সাথে মানানসই এবং সহজেই খাদ্যাভাসের অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব। 

রসুনের উপকারিতা বা শারীরিক সুস্থতায় রসুন (Benefits fo Garlic)

উপরের সংক্ষিপ্ত আলোচনায় একটি ব্যাপার সহজেই বুঝা যাচ্ছে, তা হলো রসুনের উপকারিতা অনেক। এর এমন অনেক গুণ রয়েছে যা প্রমাণের জন্য দীর্ঘমেয়াদী গবেষণা প্রয়োজন। কিন্তু এমন অনেক উপকারিতা রয়েছে যা আমাদের অজানা না।

এমনই কিছু অনন্য উপকারিতা নিয়ে এই পর্যায়ে আলোচনা করা হলো: 

১. শরীর থেকে ক্ষতিকারক পদার্থ নিষ্কাশনে:

মানবদেহ চলমান বিপাকীয় ক্রিয়ার কারনে বিভিন্ন টক্সিন বা ক্ষতিকারক পদার্থ তৈরি হয়। এই সকল পদার্থ মানবদেহে বিভিন্ন রকমের ক্ষতির কারন হতে পারে। আমাদের শরীর একটি প্রক্রিয়ায় এই সকল ক্ষতিকারক পদার্থ বের করে দেয়। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় ডিটক্সিফিকেশন (Detoxification)।

এমন কিছু খাবার আছে যা আমাদের শরীর থেকে ক্ষতিকারক পদার্থ নিষ্কাসনে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই সকল খাবারকে ডিটোক্স ফুড বলে। রসুন একটি অত্যন্ত কার্যকর ডিটোক্স। এতে বায়ো একটিভ সেলেনিয়াম, সালফার ও গ্লুটাথিওন রয়েছে। এই পদার্থসমূহ ডিটোক্সে সাহায্য করে। 

২. এন্টিবায়োটিক গুনে অনন্য:

রসুন এন্টিবায়োটিক গুণসম্পন্ন। এতে রয়েছে অ্যালিসিন। অ্যালিসিন হল একটি বায়োঅ্যাকটিভ এন্টিবায়োটিক যা সংক্রমণ এবং ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করতে সহায়তা করে। অ্যালিসিন যেসকল অনুজীবের উপরে কাজ করে:

  • ছত্রাক এবং এর বিভিন্ন উপাদান
  • প্রোটোজোয়া 
  • ভাইরাল সংক্রমণ
  • বিভিন্ন রকমের ব্যাকটেরিয়া, উদাহরণস্বরূপ সেলমোন্যালা

অ্যালিসিন একটি কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। প্রচলিত নির্ধারিত অ্যান্টিবায়োটিকের সাথে একত্রে ব্যবহার করা হলে আরোও বেশি সুফল পাওয়া সম্ভব।

৩. কোলেস্টেরোলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে: 

কোলেস্টেরল রক্তের একটি চর্বি জাতীয় উপাদান। দুই ধরণের কোলেস্টেরল রয়েছে: "স্বাস্থ্যের জন্য খারাপ" LDL কোলেস্টেরল এবং "ভালো" HDL কোলেস্টেরল। শরীরে অনেক বেশি LDL কোলেস্টেরল এবং পর্যাপ্ত HDL কোলেস্টেরল না থাকলে গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা হতে পারে।

একটি গবেষনায় দেখা গিয়েছে, প্রতিদিন রসুন গ্রহণ মোট কোলেস্টেরলের পরিমাণ এবং LDL এর মাত্রা ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কমাতে পারে।

অধিকন্তু, রসুন খাওয়া আপনার HDL বা ভালো কোলেস্টেরলের মাত্রাকে প্রভাবিত করে না। কারোও যদি হৃদরোগের পারিবারিক ইতিহাস থেকে থাকে বা এমন কেও যিনি হৃদরোগে ভুগছেন তবে তার খাদ্যতালিকায় এটি যুক্ত করার কথা বিবেচনা করা উচিত। 

৪. উচ্চ রক্তচাপ কমাতে:

স্ট্রোক এবং হার্ট অ্যাটাক বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য স্বাস্থ্য উদ্বেগগুলির মধ্যে দুটি। উচ্চ রক্তচাপ হৃদরোগের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য ঝুঁকির কারণ। এটি প্রায় ৭০% স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক এবং দীর্ঘস্থায়ী হৃদযন্ত্রের ব্যর্থতার কারণ বলে মনে করা হয়। বিশ্বব্যাপী ১৩.৫ শতাংশ মৃত্যুর কারণ উচ্চ রক্তচাপ।

যারা উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশনে ভুগছেন তাদের জন্য খাদ্য তালিকায় রসুন অন্তর্ভুক্ত করা একটি ভালো সমাধান হতে পারে। কারো যদি রসুন ভালো না লাগে, তবুও এটি গ্রহণ করা উচিত। কারন এমনটা করলে অনেক স্বাস্থ্যগত সুবিধা পাওয়া সম্ভব, যেমন: উচ্চ রক্তচাপ কমানো। 

৫. ক্যান্সার প্রতিরোধে: 

রসুনে বিদ্যমান বিভিন্ন সালফার যৌগ ক্যান্সার কোষকে বাধা প্রদান করে। একই সাথে এটি বিভিন্ন রকমের টিউমারকেও বাঁধা প্রদান করে।  কোলন, প্রোস্টেট, অন্ননালী এবং কিডনির ক্যান্সারের ক্ষেত্রে এর কার্যকারীতার প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে এইক্ষেত্রে আরোও গবেষণার দাবি রাখে। 

আইওয়া উইমেনস হেলথ স্টাডি অনুসারে, যেসব মহিলারা অন্যান্য শাকসবজি এবং ফলের সাথে নিয়মিত রসুন খান, তাদের কোলন ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা ৩৫% শতাংশ কম। 

৬. পরিপাকে সাহায্য: 

রসুন হজম শক্তি বৃদ্ধি করে। পেটের ঝিল্লিকে অধিক গ্যাস্ট্রিক রস তৈরি করতে উদ্দীপিত করে, যা হজমে সহায়তা করে। এটি শরীর থেকে বর্জ্য অপসারণে সহায়তা করে এবং পাকস্থলীর প্রদাহের মতো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কমায়।

রসুনে প্রাকৃতিকভাবে প্রচুর পরিমাণে ইনুলিন রয়েছে। ইনুলিন হচ্ছে এক ধরনের অপাচ্য কার্বোহাইড্রেট বা "কার্যকরী ফাইবার" যা ক্ষুদ্রান্ত্রের গাট ফ্লোরা জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে যা সামগ্রিকভাবে অন্ত্রের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে।

রসুনে ব্যাকটেরিয়ারোধী বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা E.coli এবং Salmonella এর ​​বিরুদ্ধে লড়াই করে, এই দুটি জীবাণু খাদ্যে বিষক্রিয়া সৃষ্টি করে। রসুনের সালফার যৌগগুলি পরিপাকতন্ত্র থেকে শরীরে প্রবেশ করে। 

৭. অধিক পুষ্টিগুণ সম্পন্ন

রসুন বিভিন্ন রকমের পুষ্টি উপাদান সমৃদ্ধ। এটিতে ক্যালোরি কম কিন্তু সেই অনুপাতে পুষ্টি উপাদানের পরিমান অনেক বেশি। রসুন খাওয়ার মাধ্যমে একজন মানুষ তার শরীরের ম্যাঙ্গানিজ, ভিটামিন বি 6, জিঙ্ক, সালফার, আয়রন, ভিটামিন সি, পটাসিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, সেলেনিয়াম এবং আরও অনেক ভিটামিন ও মিনারেলের ঘাটতি পূরণ করতে পারে।

৮. মস্তিস্কের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি: 

ফ্রি রেডিক্যাল বার্ধক্য প্রক্রিয়াকে ত্বরাণ্বিত করে। এর এন্টি-অক্সিডেন্ট শরীরকে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে। খাদ্যে এন্টিঅক্সিডেন্টের বর্ধিত পরিমাণ মস্তিস্ককে বার্ধক্যের প্রভাব থেকে রক্ষা করতে পারে।

এই কারণে এটি বিভিন্ন রকমের মস্তিষ্কের রোগ যেমন আলঝাইমার এবং ডিমেনশিয়া প্রতিরোধ করতে পারে। অনেকক্ষেত্রেই এখন ডাক্তার ও পুষ্টিবিদগণ রোগীদের রসুন গ্রহণ করার পরামর্শ প্রদান করে থাকেন।

৯. দীর্ঘায়ু নিশ্চিতকরণে: 

রসুনের স্বাস্থ্য উপকারিতার কারণে, এটি বেশি পরিমাণে গ্রহণ করা হলে একজন দীর্ঘায়ু লাভ করতে পারে । রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী হয়, অনেক কঠিন রোগ থেকে দূরে থাকা যায়। ক্যান্সার ও টিউমার এর মতো রোগ দূরে রাখার মাধ্যমে রসুন দীর্ঘায়ু নিশ্চিত করতে সাহায্য করে থাকে। 

অধিক রসুন গ্রহণ জনিত সতর্কতা: 

অতিরিক্ত রসুন খাওয়ার ফলে ফুসকুড়ি, গ্যাস্ট্রিক জনিত সমস্যা এবং পেট খারাপ হতে পারে। রসুন খাওয়ার ফলেও নিঃশ্বাসে দুর্গন্ধ হয়। একই সাথে, এটি রক্ত ​​পাতলাকারী হিসেবে কাজ করতে পারে এবং এইচআইভি রোগে আক্রান্ত রোগীদের ঔষধের সাথে হস্তক্ষেপ করতে পারে। তাই অতিরিক্ত রসুন গ্রহণ অনেকের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে এই সকল সমস্যা সকলের ক্ষেত্রে দেখা দেয় না। 

এই কথা অনস্বীকার্য যে রসুন পুষ্টিগুণে অতুলনীয়। প্রতিদিন এই মশলা গ্রহণের পরামর্শও প্রদান করা হয়। কিন্তু একটি ব্যাপার মনে রাখতে হবে, কোন একটি নির্দিষ্ট খাবার যতই ভালো হোক না কেনো তা কখনোই সুষম খাবারে বিকল্প নয়। আবার অতিরিক্ত রসুন গ্রহণ ক্ষতির কারণও হতে পারে। এই কারণে আমরা পরিমিত পরিমাণে নিয়মিত রসুন গ্রহণের চেষ্টা করবো যেন আমরা এর দ্বারা উপকৃত হতে পারি।