কালোজিরার উপকারিতা ও পুষ্টিতথ্য

বাংলাদেশে কালোজিরা চিনে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। যুগ যুগ ধরে এটি রন্ধন শিল্পে এবং ঐতিহ্যগত ঔষধ হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে।

কালোজিরা সাধারণত নাইজেলা (Nigella), ব্ল্যাক কিউমিন (Black Cumin), ব্লাক সিড (Black Seed) ইত্যাদি নামেও পরিচিত এবং এটির বিস্তৃতি দক্ষিণ এশিয়া থেকে শুরু করে ভূমধ্যসাগরীয় এলাকা ছাড়িয়ে সুদূর আফ্রিকা পর্যন্ত। বর্তমানে সারা বিশ্বেই কালোজিরা নিয়ে গবেষণা হচ্ছে এবং দিন দিন এর আশ্চর্য পুষ্টি গুণাগুণ সকলের সামনে উন্মুক্ত হচ্ছে।

কালোজিরার (Black Seed) পুষ্টিগুণ ও পুষ্টিতথ্য

কালোজিরা পুষ্টিগুণে পরিপূর্ণ। আমরা যদি ২০০৪ সালে রিসার্চ গেট জার্নালে প্রকাশিত পুষ্টিবিজ্ঞানী সুরেশ কে মালোত্রার কালোজিরা বিষয়ক গবেষণার দিকে খেয়াল করি তবে দেখতে পাই, প্রতি ১০০ গ্রাম কালোজিরা আমাদের অনেক মিনারেলের চাহিদা পূরণ করে।

প্রতি ১০০ গ্রাম কালোজিরায় রয়েছে:

প্রোটিন ২২ গ্রাম 
ফ্যাট ৪১ গ্রাম
কার্বোহাইড্রেট ১৭ গ্রাম
ডায়েটারি ফাইবার ৮ গ্রাম
পানি ৪ গ্রাম 
সোডিয়াম ০.৫ গ্রাম (দৈনিক চাহিদা ২.৩ গ্রাম)
পটাশিয়াম ০.৫ গ্রাম (৩.৪ গ্রাম)
ক্যালসিয়াম ০.২ গ্রাম (১ গ্রাম)
ফসফরাস ০.৫ গ্রাম (০.৭ গ্রাম)
লোহা ১০ মিগ্রা (৮ মিগ্রা)
থায়ামিন ১.৫ মিগ্রা
নিয়াসিন ৬ মিগ্রা
পাইরিডক্সিন ০.৭ মিগ্রা
টোকোফেরল ৩৪ মিগ্রা

উপরের তালিকায় মিনারেলের নামের পাশাপাশি এদের দৈনিক চাহিদার পরিমাণও দেওয়া আছে। এর থেকে আমরা কালোজিরার পুষ্টিগুণাবলির ধারণা পেতে পারি। কালোজিরা একই সাথে বিভিন্ন ভিটামিনের সংস্থানেও কাজ করে। বিভিন্ন রকমের বি ভিটামিন যেমন: থায়ামিন (B1), নিয়াসিন (B3) এবং পাইরিডক্সিন (B6) এর বড় উৎস হলো কালোজিরা। একই সাথে টোকোফেরল নামের ভিটামিন ই এর উৎসও এটি।

একই সাথে এতে প্রচুর পরিমাণে এন্টিঅক্সিডেন্ট, এন্টি ইনফ্লামেটরি এবং এন্টি ক্যান্সার উপাদান রয়েছে যা বিভিন্ন রকমের অসুখ প্রতিরোধ করতে কালোজিরাকে অনন্য করে তুলেছে।

কালোজিরার উপকারিতা:

কালোজিরা এমন একটি খাবার যার উপকারিতা বলে শেষ করা যাবে না। প্রাচীনকাল থেকে আমরা এর অনেক উপকারের কথা জেনে থাকলেও, আধুনিক বিজ্ঞানের কালোজিরা নিয়ে গবেষণা তুলনামূলকভাবে নতুন। নিম্নে কালো জিরার এমন কিছু উপকারিতা নিয়ে আলোচনা করা হলো:

১. ইনফ্লামেশন কিংবা প্রদাহ কমায়:

কালোজিরাতে বিভিন্ন রকমের এন্টি অক্সিডেন্ট রয়েছে। এই সকল এন্টি-অক্সিডেন্ট ফ্রি রেডিক্যালের বিরুদ্ধে কাজ করে। ফ্রি রেডিক্যাল আমাদের শরীরে বিভিন্ন রকমের ক্ষতি করে থাকে। এর মাঝে একটি হলো এরা বিভিন্ন রকমের ইনফ্লামেশন তৈরি করে। Thymoquinone, Carvacrol, t-anethole এবং 4-terpineol এর মতো উপাদানসমূহ শক্তিশালী এন্টি অক্সিডেন্ট এবং এই উপাদানসমূহ কালোজিরাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে রয়েছে।

২. ভিটামিন ও মিনারেলের উৎস:

কালোজিরা সোডিয়াম, পটাসিয়াম, ক্যালসিয়ামসহ বিভিন্ন রকমের মিনারেলে সমৃদ্ধ। এটি মিনারেলের দৈনিক চাহিদার একটি বড় অংশ সরবরাহ করতে পারে। এই সকল মিনারেল শরীরে বিভিন্ন রকমের কাজ করে থাকে।

  • সোডিয়াম- হৃদপেশীরে সংকোচন প্রসারণ নিয়ন্ত্রণ করে।
  • পটাসিয়াম- কোষের জলীয় ভারসাম্য রক্ষা করে।
  • ক্যালসিয়াম- হাড়ের গঠনে এর অবদান অনস্বিকার্য।
  • লোহা- হিমোগ্লোবিনের মূল উপাদান, যা অক্সিজেন বহনের জন্য অপরিহার্য।

একই সাথে কালোজিরা থায়ামিন (B1) ও নিয়াসিন (B3) এর বড় উৎস। থায়ামিন আমাদের শরীরের বিভিন্ন শরীরবৃত্তীয় কাজ পরিচালনা করে এবং মস্তিষ্কের গঠনে সাহায্য করে। অপর দিকে নিয়াসিন কোলেস্টেরল লেভেল কমাতে সাহায্য করে। প্রয়োজনীয় উপকারী চর্বির সংস্থানেও সাহায্য করে। কালোজিরাতে উপস্থিত পাইরিডক্সিন (B6), এন্টিবডি তৈরি করে এবং আমাদের ইমিউন সিস্টেমকে সাহায্য করে। একই সাথে কালোজিরা ভিটামিন ই এরও জোগান দেয়।

৩. কোলেস্টেরোল এর মাত্রা হ্রাস করে:

কালোজিরা আমাদের দেহের প্লাজমা লিপিড এর মাত্রায় সরাসরি অবদান রাখে। এর ফলে রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা হ্রাস পায়। ট্রাই গ্লিসারাইড এর মাত্রা কমাতেও এর অবদান রয়েছে।

স্থূলতা সমস্যায় ভোগা একদল মানুষের উপরে করা একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, কালোজিরা স্থূলতা ও ওজন কমাতে এবং কোলেস্টেরোল হ্রাস করতে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। একই সাথে আরোও একটি ব্যাপার এই গবেষণায় নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হয়েছিলো, কালোজিরা গ্রহণের পরিমাণ এবং সময়কাল যত বেশি হবে তত বেশি ভালো ফল পাওয়া যাবে।

৪. ক্যান্সার প্রতিরোধ করে:

কালোজিরা তেল কোলোন ও ফুসফুসের টিউমারের আকার হ্রাস করতে ভূমিকা রাখে। একই সাথে এটি বিভিন্ন রকমের ক্যান্সারকে প্রতিরোধ করে। স্তন ক্যান্সার, স্কিন ক্যান্সার, প্রোস্টেট ক্যান্সার প্রশমনে এর ভূমিকা অনেকটাই প্রমাণিত।

কালোজিরা ক্যান্সার ও টিউমারের কোষ বৃদ্ধিতে বাঁধা প্রদান করে। ক্যান্সার কোষকে পার্শ্ববর্তী কোষে ছড়িয়ে পড়া বন্ধ করতেও এর অবদান রয়েছে। একই সাথে এটি প্রদাহ কমায় এবং রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে।

৫. ব্লাড সুগার এর মাত্রা নিয়ন্ত্রণে:

ডায়াবেটিক রোগীদের রক্তে সুগার লেভেল কমাতে কালোজিরা ব্যবহার করা হয়। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, যে সকল ডায়াবেটিক রোগী প্রতিদিন দুই গ্রাম কালোজিরা গ্রহণ করে তাদের ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে থাকে।

অনেক গবেষক মনে করেন, কালোজিরা মানবদেহে ইনসুলিন এর ক্ষরণ বৃদ্ধি করে। ইনসুলিন এমন একটি হরমোন যা আমাদের রক্তের সুগারকে ব্যবহার করে। এটি গ্লুকোজকে দেহের কোষে প্রবেশ করায় যা অতিরিক্ত গ্লুকোজের পরিমান কমায় এবং শরীরও শক্তি লাভ করে। 

৬. এন্টি অক্সিডেন্ট ও এন্টি ইনফ্লামেটরি এজেন্ট এর বিশাল উৎস:

কালোজিরা বিভিন্ন রকমের এন্টি অক্সিডেন্ট এবং এন্টি ইনফ্লামেটরি পদার্থে পরিপূর্ণ যা মানবদেহে বিভিন্ন রকমের কাজ করে থাকে। এই সকল উপাদানের মাঝে রয়েছে থাইমল, পলিফেনল, টোকোফেরোল, বিভিন্ন রকমের তেল ইত্যাদি। এই সকল উপাদানের উপকারিতা বলে শেষ করা যাবে না। কিছু উপকারিতার মাঝে রয়েছে:

  • ইনফ্লামেশন এর সম্ভাবনা কমায়
  • কোষের ক্ষয় রোধ করে
  • ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়
  • হাড়ের ক্ষয় রোধ করে
  • মাংসপেশিতে ব্যথা কমায়
  • ত্বককে মসৃণ রাখে
  • হৃদরোধ, অটোইমিউন ডিজিজ এর ঝুঁকি কমায়

৭. পরিপাক তন্ত্রের সুরক্ষায়:

কালোজিরা ডায়েটারি ফাইবারে পরিপূর্ণ। ডায়েটারি ফাইবার মানবদেহের পরিপাক তন্ত্রের জন্য উপকারী। ফাইবার ক্ষুদ্রান্ত্রকে সুস্থ রাখে, গাট ফ্লোরার বিকাশে উপযুক্ত পরিবেশ প্রদান করে।

একই সাথে কালোজিরা পাকস্থলীতে অনিয়ন্ত্রিত কোষ বিভাজনে বাঁধাপ্রদান করে। অনিয়ন্ত্রিত কোষ বিভাজনের ফলে ক্যান্সার ও টিউমার তৈরি হয়। এই সমস্যা সৃষ্টিতে বাঁধা দিয়ে এটি আমাদের পরিপাক তন্ত্রকে সুস্থ রাখে।

৮. যৌন সমস্যা সমাধানে:

মানবদেহে ফ্রি রেডিক্যাল বেড়ে গেলে পুরুষদের শুক্রানুর সংখ্যা কমতে শুরু করে। যা পৌরষত্বহীনতায় রূপ নিতে পারে। একই ভাবে ফ্রি রেডিক্যালের আধিক্য নারীদের ডিম্বক ধারণক্ষমতা কমাতেও ভূমিকা রাখে। যা অনেক সময় বন্ধ্যাত্বে রূপ নেয়।

একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে যারা নিয়মিত কালোজিরা গ্রহণ করে, তাদের ফ্রি রেডিক্যাল সংক্রান্ত যৌন সমস্যার রূপ কম থাকে। নিয়মিত কালোজিরা গ্রহণ করলে শুক্রানুর সংখ্যা ও সন্তান ধারণ ক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়।

৯. ত্বকের সুরক্ষায়:

আমাদের মাঝে অনেকেই রয়েছেন যারা বিভিন্ন রকমের ত্বকের সমস্যায় ভুগছেন। ব্রণ, মেছতা, বলিরেখার মতো সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় অহরহ। নিয়মিত কালোজিরা গ্রহণে ত্বকের সুস্থতা নিশ্চিত হয়। ব্রণ মেছতার প্রকোপ কমে আসে, বলিরেখা মিলিয়ে যায়। অনেকের ক্ষেত্রে চেহারার লাবণ্যও ফেরত আসে।

১০. কিডনি, ফুসফুস ও লিভারের সুরক্ষায়:

কালোজিরা অক্সিডেটিভ স্ট্রেস এর বিপক্ষে কাজ করে। অক্সিডেটিভ স্ট্রেস আমাদের লিভারের ক্ষতি করে। যে সকল উপাদান লিভারের সুরক্ষায় সরাসরি সাহায্য করে তার মাঝে থাইমোকুইনোন অন্যতম। এই উপাদান লিভারকে পরজীবীর আক্রমণ থেকেও রক্ষা করে।

একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, কালোজিরা সেবন এজমার প্রকোপ কমায় এবং পালমোনারি ফাংশন এর উন্নতি করে। একই সাথে, কালোজিরা তেল কিডনির পাথর প্রতিহত করে। ক্যালসিয়াম অক্সালেট জমে পাথরের সৃষ্টি হয়। নিয়মিত কালোজিরা সেবন করলে কিডনির ক্যালসিয়াম অক্সালেট শরীরে জমতে পারে না, ফলে কিডনিতে পাথরও জমে না।

কালোজিরা আমাদের অতি পরিচিত বীজ জাতীয় খাদ্য। একই সাথে এটি সহজলভ্যও বটে। বিভিন্ন রকমের শারীরিক সমস্যা প্রতিরোধে কালোজিরা একটি ভালো পথ্য হতে পারে। যদিও কালোজিরার কিছু উপকারিতা এখনও প্রমাণসাপেক্ষ তবুও ধীরে ধীরে আধুনিক বিজ্ঞান কালোজিরার গুরুত্ব স্বীকার করে নিচ্ছে। প্রতিদিন কালোজিরা সেবনের মাধ্যমে আমরা এর গুণাগুণ গ্রহণ করতে পারি।