স্বাস্থ্য সচেতনার এই যুগে দিন দিন চিয়া সিডের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আকারে ছোট হলেও এই বীজজাতীয় শস্য বিভিন্ন রকমের পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ। সুপ্রাচীন মায়া কিংবা এজটেক সভ্যতাতেও এই বীজ ব্যবহারের নজির পাওয়া যায়। বর্তমান সময়েও এই খাদ্যবীজের চাহিদা বিন্দুমাত্র কমে নি বরং নতুন নতুন খাদ্যপ্রস্তুত কৌশল এর ব্যবহার আরোও বাড়িয়ে তুলছে।
চিয়া সিডের পুষ্টিতথ্য:
Chia Seeds খুবই পুষ্টিকর একটি বীজ। আকারে ছোট হলেও এতে বিভিন্ন রকমের পুষ্টি উপাদান অত্যাধিক পরিমাণে রয়েছে যেমন: প্রোটিন, ফাইবার, ওমেগা-থ্রি ফ্যাটি এসিড, মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট। মাত্র ১ আউন্স পরিমাণে যে পরিমাণ পুষ্টি উপাদান রয়েছে তা আমাদের অবাক করে দিতে যথেষ্ট।
পুষ্টি উপাদানের পরিমাণ USDA অনুযায়ী (১ আউন্স বা ২৮ গ্রাম ):
- এনার্জি বা শক্তি: ১৩৮ ক্যালোরি
- প্রোটিন: ৪.৭ গ্রাম
- ফ্যাট বা চর্বি: ৮.৭ গ্রাম
- কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা: ১১.৯ গ্রাম
- ফাইবার: ৯.৮ গ্রাম
- ক্যালসিয়াম: ১৭৯ মিগ্রা (দৈনিক চাহিদার ১৪%)
- আয়রন বা লোহা: ২.২ মিগ্রা (দৈনিক চাহিদার ১২%)
- ম্যাগনেসিয়াম: ৯৫ মিগ্রা দৈনিক চাহিদার ২৩%
- ফসফরাস: ২৪৪ মিগ্রা (দৈনিক চাহিদার ২০%)
- জিংক: ১মিগ্রা (দৈনিক চাহিদার ১২%)
- সোডিয়াম : ৪.৫ মিগ্রা
- পটাসিয়াম : ১১৫ মিগ্রা
- ভিটামিন বি১: দৈনিক চাহিদার ১৫%
- ভিটামিন বি৩: দৈনিক চাহিদার ১৬%
- আলফা লিনোলিক এসিড (ALA) : ৫ গ্রাম
উপরের তালিকা থেকে বুঝা যাচ্ছে, সামান্য পরিমাণ চিয়া সিড কত বেশি পরিমাণে পুষ্টি উপাদান ধারণ করতে পারে। বিভিন্ন ভিটামিন ও মিনারেলের দৈনিক চাহিদার একটা বড় অংশ চাইলে এই বীজ থেকে আমরা পেতে পারি।
চিয়া সিডের উপকারিতা:
১. ওজন কমাতে:
অতিরিক্ত ওজন ঝেড়ে ফেলতে Chia Seeds এর ব্যবহার সর্বোচ্চ লক্ষ্যণীয়। এতে প্রচুর পরিমাণে খাদ্যআশ বা ফাইবার রয়েছে। ফাইবার পেটে পুর্ণতার অনুভুতি দীর্ঘস্থায়ী করে, এর ফলে অতিরিক্ত খাবার গ্রহণের পরিমাণ কমে যায়।
ফাইবার একই সাথে মানবদেহের ক্ষুদ্রান্ত্রের স্বাস্থ্যের জন্যও ভালো। এটি আমাদের গাট ফ্লোরাকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি প্রদান করে, এর ফলে খাদ্যের হজম ও পুষ্টির বন্টনে সহয়তা হয়। ফলে অতিরিক্ত চর্বি শরীরে জমতে পারে না।
একই সাথে এতে স্বাস্থ্যের জন্য উপকারি ফ্যাট ও প্রোটিনের পরিমাণ বেশি। একারণে অতিরিক্ত শর্করা গ্রহণের পরিমাণ কমে যায়। একই সাথে পেটের চর্বি কাটাতেও এই বীজ জাতীয় শস্যের উপকারিতা অনস্বীকার্য।
২. কোষ্ঠকাঠিন্য দূরীকরণে Chia Seeds:
আমাদের আশেপাশে এমন অনেককেই খুজে পাওয়া যাবে যারা কোষ্ঠকাঠিন্যজনিত সমস্যায় ভুগছেন। এই সমস্যার সহজ সমাধান হতে পারে চিয়া সিড। পানিতে ভিজিয়ে রাখা হলে চিয়া সিড জেল জাতীয় পদার্থ তৈরি করে। এটি খাবারকে পর্যাপ্ত পিচ্ছিলতা প্রদান করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে।
বাসিল সিড (তোকমা) এবং ইসুপগুলের ভুষি এর সাথে ব্যবহার করা হলে আরো ভালো ফলাফল পাওয়া যেতে পেরে।
৩. ব্লাড সুগার ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে:
চিয়া সিডের জিলাটিন সদৃশ আবরণ ব্লাড সুগারের মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধিতে বাধা প্রদান করে। যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব এগরিকালচার এর ভাষ্যমতে এই সিড ঐ সকল খাবারের একটি যারা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
একই সাথে ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণেও এর অবদান রয়েছে। Chia Seed এ পর্যাপ্ত ওমেগা থ্রি (Omega 3) রয়েছে। এটি এমন একটি উপাদান যা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে মুখ্য ভূমিকা পালন করে বলে ধারণা করা হয়।
৪. বিভিন্ন ক্যান্সার প্রতিরোধে:
চিয়া সিডে আলফা লিনোলিক এসিড রয়েছে। এটি একটি প্রয়োজনীয় এমাইনো এসিড। আলফা লিনোলিক এসিড ক্যান্সার প্রতিরোধে কাজ করে।
একই সাথে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিডও ক্যান্সার ও টিউমার কোষকে জন্ম নিতে এবং ছড়িয়ে পড়তে বাধা প্রদান করে থাকে। এন্টি-কারসিনোজেন এই সকল উপাদান ক্যান্সার প্রতিরোধে মুখ্য ভূমিকা পালন করে, অনাকাঙ্ক্ষিত রোগ থেকে দূরে রাখতে সাহায্য করছে।
৫. স্বাস্থ্যকর লিপিড লেভেল অর্জনে:
অনেকেই আছেন যারা স্থুলতাজনিত সমস্যায় ভুগছেন। এটি এমন একটি সমস্যা যেখানে মানবদেহের বিভিন্ন রকমের লিপিডের মাত্রা এবং ভারসাম্যের মাঝে থাকে না। এই ধরণের সমস্যা হৃদরোগ, স্ট্রোক, উচ্চ কোলেস্টেরল মাত্রা, উচ্চ রক্তচাপের মতো সমস্যা তৈরি করে।
Chia Seeds মানবদেহে HDL বা ভালো কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়ায় এবং ট্রাইগ্লিসারাইড এর মাত্রা কমায়। এর ফলে শরীরে অতিরিক্ত চর্বি জমে না, হৃদস্পন্দন স্বাভাবিক থাকে।
৬. শক্তি ও মেটাবোলিজমের উন্নতিতে:
চিয়া সিডে স্বাস্থ্যকর ফ্যাটি এসিড রয়েছে। যা শরীরে দ্রুত শক্তির সরবরাহ করতে সক্ষম। একই সাথে এতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন বি, জিংক, আয়রন ও ম্যাগনেসিয়াম রয়েছে। যা কর্মদক্ষতা,বৃদ্ধি করে।
একই সাথে, যেহেতু চিয়া সিড অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়ার জন্য ভালো সেহেতু এই খাদ্যবীজ এই উপকারি অনুজীবদের কার্যকারীতা বাড়িয়ে তোলে। এই কার্যকরীতা বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন ভিটামিন ও মিনারেলের উপস্থিতি মেটাবোলিজমেও উন্নতি সাধন করে।
৭. Chia Seeds প্রোটিনের উৎসঃ
শরীরের বিকাশে প্রোটিনের গুরুত্ব অস্বীকার করবে এমন মানুষ খুজে পাওয়া দুষ্কর। চিয়া সিডে বিভিন্ন রকমের প্রোটিনের খুবই ভালো উৎস। একটি ব্রাজিলিয়ান সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, Chia Seeds এ উপস্থিত প্রোটিন লিপিড প্রোফাইলের উন্নতিতেও সাহায্য করে।
প্রোটিন অতিরিক্ত ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণ করে, শরীরে প্রয়োজনীয় এমাইনো এসিডের সংস্থান করে। মজার ব্যাপার হলো, এই বীজের প্রায় ১৯ শতাংশই প্রোটিন। তাই আমিষের উৎস হিসেবে একে বিবেচনা করা যেতেই পারে।
৮. এন্টিঅক্সিডেন্টের উৎসঃ
সুপার ফুড হিসেবে বিবেচিত প্রায় সকল খাবারই এন্টিঅক্সিডেন্টের উল্লেখযোগ্য উৎস। চিয়াসিডও এর বিকল্প নয়। এই বীজটিতে প্রচুর পরিমাণে এন্টি অক্সিডেন্ট রয়েছে।
এন্টি এক্সিডেন্ট অতিরিক্ত ফ্রি র্যাডিকেলকে নিষ্ক্রিয় করে, শরীরের অক্সিডেটিভ ব্যালেন্স ঠিক রাখতে সাহায্য করে। একই সাথে ত্বকে বয়সের ছাপ না ফেলতে, ক্যান্সার প্রতিরোধ ও অভ্যন্তরীণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ রক্ষায় এন্টি অক্সিডেন্ট কাজ করে।
৯. হাড়, ত্বক ও দাতের গঠণে:
চিয়া সিড ত্বকের কি ধরণের উপকার করে তা এগেই বলা হয়েছে। একই সাথে হাড় ও দাতের সুরক্ষাতেও এটি ভূমিকা রাখে।
আমরা জানি, হাড় ও দাতের সুরক্ষায় ক্যালসিয়াম খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ১ আউন্স চিয়া সিড আমাদের দৈনিক চাহিদার ১৪% ক্যালসিয়ামের সংস্থান করতে সক্ষম। একই সাথে এই খাবারটি মানবদেহের ক্যালসিয়াম গ্রহণের পরিমানকেও বৃদ্ধি করে।
ভুলে গেলে চলবে না, Chia Seeds ম্যাগনেসিয়ামেরও উল্লেখযোগ্য উৎস। ১ আউন্স চিয়াসিড দৈনিক চাহিদার ২৩% পুরণ করতে সক্ষম। হাড় ও দাতকে দৃঢ় করতে ক্যালসিয়ামের পাশাপাশি ম্যাগনেসিয়ামও গুরুত্বপূর্ণ।
১০. গ্লুটেন ফ্রি খাবারের উৎস:
বিশ্বে এমন অনেক মানুষ রয়েছে যারা সিলিয়াক ডিজিজে আক্রান্ত। এই রোগে আক্রান্ত মানুষ গ্লুটেন আছে এমন খাবার খেতে পারে না। এই ধরণের খাবারের মাঝে রয়েছে গম, সিরিয়াল ইত্যাদি।
চিয়া সিড এমন একটি প্রোটিনের আঁধার যেখানে কোনো প্রকারের গ্লুটেন নেই। একই সাথে যারা সিলিয়াক রোগে আক্রান্ত তাদের ক্যালসিয়াম ও ফাইবারের ঘাটতি হওয়ার সম্ভাবনা খুবই প্রবল। চিয়া সিড এই দুইয়েরই ঘাটতি রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
১১. নিদ্রাবর্ধক:
অশ্চর্য হলেও সত্য চিয়া সিড ঘুমেরও সহায়ক। অনেকেই আছে যারা অনিদ্রাজনিত সমস্যায় ভুগছেন। এমন সমস্যায় আক্রান্তরা ঘুমানোর আগে এই খাবারটি পানির সাথে গ্রহণ করলে উপকার পেতে পারেন।
কিছু সতর্কতা:
একটু জিনিস যতই ভালো হোক, অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো না। এই কারণে অতিরিক্ত Chia Seeds গ্রহণও হীতে বিপরীত হতে পারে। অতিরিক্ত পরিমাণে গ্রহণ করা হলে, পেটের সমস্যা, গাট ফ্লোরার ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার মতো সমস্যা হতে পারে।
চিয়া সিড একটি স্বাস্থ্যকর খাবার। আমরা চাইলে একে আমাদের প্রতিদিনের খাদ্যতালিকার অন্তর্ভুক্ত করতে পারি। চিয়া সিড নানা উপায়ে খাবারের সাথে গ্রহণ করা যায়। নিজস্ব রুচি ও পছন্দ অনুযায়ী পন্থা বেছে নিয়ে আমরাও এই খাবারটি দ্বারা উপকৃত হতে পারি।