অলিভ অয়েলের (Olive Oil) উপকারিতা এবং পুষ্টিতথ্য

স্বাস্থ্যকর তেল হিসেবে অলিভ অয়েলের খ্যাতি বিশ্বজুড়ে। সারা পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষ রান্না, বেকিং কিংবা শরীর ও সুন্দর্য চর্চায় অলিভ অয়েল ব্যবহার করে থাকে। এটি এমন একটি খাবার যা নিয়ে সারা বিশ্বে বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিস্তৃত গবেষণা করেছেন। তাদের গবেষণার ফলস্বরূপ আমরা এই তেলের স্বাস্থ্য উপকারিতার ব্যাপারে অবগত হতে পেরেছি।

অলিভ অয়েলের পুষ্টিতথ্য

অলিভ অয়েলকে (Olive Oil) কেনো পুষ্টিকর তেল হিসেবে বিবেচনা করা হয় তা জানতে হলে আমাদের এর পুষ্টি উপাদান সমূহের দিকে খেয়াল করতে হবে। অন্যান্য অনেক অস্বাস্থ্যকর তেলের সাথে অলিভ অয়েলের মূল পার্থক্য এর স্যাচুরেটেড ও আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট এর পরিমাণে।

এক টেবিল চামচ (প্রায় ১৪ গ্রাম) অলিভ অয়েলে নিম্নলিখিত পুষ্টি উপাদান রয়েছে:

  • ক্যালোরি: ১১৯ কিলোজুল
  • স্যাচুরেটেড ফ্যাট: মোট ক্যালোরির ১৪%
  • মনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট: মোট ক্যালোরির ৭৩% (বেশিরভাগ ওলিক অ্যাসিড)
  • পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট (PUFA): মোট ক্যালোরির ১১%
  • ভিটামিন ই: দৈনিক চাহিদার ১৩% (DV)
  • ভিটামিন কে: দৈনিক চাহিদার ৭%

অলিভ অয়েল এন্টিঅক্সিডেন্টের একটি বিশাল উৎস, যা ইনফ্লামেশন এবং বিভিন্ন দীর্ঘস্থায়ী রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে । 

অলিভ অয়েল এর উপকারিতা:

Olive Oil এর বিভিন্ন উপকারিতা রয়েছে। প্রাচীন কাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত এর জনপ্রিয়তা এবং গ্রহণযোগ্যতায় কোনো ভাটা পড়েনি বরং এর ব্যবহার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে।

সংক্ষেপে এই অসাধারণ স্নেহ জাতীয় খাবারটির গুণাবলী ও উপকারিতা নিয়ে আলোচনা করা হলো: 

১. হৃদপিণ্ডের সুস্থতায়:

এই তেলের প্রধান এন্টিঅক্সিডেন্টগুলির মধ্যে রয়েছে এন্টি-ইনফ্ল্যামেটরি oleocanthal (ওলিওক্যানথাল) এবং oleuropein (অলিউরোপেইন)। এই সকল পদার্থ যা LDL কে অক্সিডেশন থেকে রক্ষা করে, এর ফলে এই কোলেস্টেরল শরীরের ক্ষতি করতে পারে না ।

এই তেলে স্যাচুরেটেড ফ্যাটের পরিমাণ অনেক কম। অন্যদিকে শরীরের জন্য উপকারী মনোআনস্যাচুরেটেরড ফ্যাটের পরিমাণ অনেক বেশি। এর ফলে শরীরে খারাপ ফ্যাটের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় না। এর ফলে কোলেস্টেরল লেভেল নিয়ন্ত্রণে থাকে, হার্টের স্বাস্থ্য ভালো থাকে, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে

একই সাথে এই তেলে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ই এবং কে রয়েছে। এই ভিটামিন সমূহ হৃদপিণ্ডের জন্য উপকারী। সার্বিকভাবে অলিভ অয়েলের নিয়মিত ব্যবহার কার্ডিও ভাস্কুলার সিস্টেমকে কিছু সুফল দিতে পারে:

  • হার্টের ইনফ্লামেশন এর ঝুঁকি কমায়
  • LDL এর অক্সিডেশন হতে বাঁধা দেয়
  • শিরা ও ধমনীতে সংকীর্ণ হতে বাঁধা প্রদান করে 
  • শিরা-উপশিরার অভ্যন্তরে রক্ত জমাট বাধতে বাঁধা প্রদান করে
  • উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধ করে

২. ইনফ্লামেশন প্রতিরোধে:

Olive Oil শুধু হৃদপিণ্ডের ইনফ্লামেশনে বাঁধা প্রদান করে এমনটা নয়। বিভিন্ন রকমের ইনফ্লামেশনে বাঁধা প্রদান করতে এই তেল সাহায্য করে। অলিভ অয়েল হলো এন্টি অক্সিডেন্টের বিশাল ভাণ্ডার। এই উপাদানগুলো ফ্রি-র‍্যাডিকেলের বিপক্ষে কাজ করে, যার ফলে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস বৃদ্ধি পায় না। অক্সিডেটিভ স্ট্রেস বৃদ্ধি পেলে বিভিন্ন রকম শারীরিক সমস্যা হতে পারে। এর মাঝে রয়েছে দ্রুত বয়স বৃদ্ধি, ইনফ্লামেশন, ক্যান্সার ইত্যাদি।

৩. ত্বক, চুল ও নখের যত্নে:

এটি ত্বক, চুল ও নখের সুস্থতায় গুরুত্বপূর্ণ। সৌন্দর্য চর্চা থেকে শুরু করে এই অঙ্গসমুহের সুরক্ষায় এই তেলটি ব্যবহার করা হয়। জেনে কিংবা না জেনে প্রতিনিয়তই Olive Oil ব্যবহারের মাধ্যমে এই সকল স্বাস্থ্য উপকারিতা গ্রহণ করে যাচ্ছি আমরা।

Olive Oil ভিটামিন ই তে পরিপূর্ণ। এটি বিভিন্ন রকমের ত্বকের সমস্যা যেমন: বলিরেখা, একনি, মেছতার মতো সমস্যার সাথে মোকাবেলা করে। একই সাথে এটি ত্বকের ক্যান্সার প্রতিরোধেও আমাদের দেহকে সাহায্য করে। একই সাথে Olive Oil বয়সের ছাপও কমায়।

অনেকে চুল ও নখের সুরক্ষাতে এই তেল ব্যবহার করে থাকেন। এটি চুলকে সতেজ করে, পড়ে যাওয়া, ফেটে যাওয়ার ঝুঁকি কমায়। একই সাথে নিয়মিত অলিভ অয়েল সেবন করা হলে, নখের স্বাস্থ্য ও সৌন্দর্যও রক্ষিত হয়।

৪. হতাশা কাটাতে:

হতাশা কিংবা বিষণ্নতা মানুষের একটি বৈশিষ্ট্য। সবাই কোনো না কোন সময় এর কড়াল গ্রাসের সম্মুখীন হয়েছে, মজার ব্যাপার হলো, অলিভ অয়েল মুড সুইং ঠিক করতে ব্যবহৃত হতে পারে।

নিয়মিত Olive Oil গ্রহণ করলে মস্তিষ্ক নিয়মিত সেরটোনিন ক্ষরণ করে। সেরোটোনিন এমন একটি রাসায়নিক পদার্থ যা আমাদের মনে আনন্দের অনুভূতি তৈরি করতে পারে। এই কারনে হতাশা কাটাতে এটি একটি ব্যতিক্রমী পথ্য হতে পারে।

৫. স্নায়ুকোষ এর সুরক্ষায়:

অলিভ অয়েল এর নিউরোপ্রটেকটিভ ক্ষমতা রয়েছে অর্থাৎ এটি নিউরন বা স্নায়ুকোষকে সুরক্ষা করার ক্ষমতা রাখে। নিউরনকে সুরক্ষা করার কারণে এটি বিভিন্ন রকমের স্নায়ুরোগের লক্ষণ উপশমে কার্যকর।

সারা বিশ্বে Alzheimer’s Disease সবচেয়ে পরিচিত নিউরোডিজেনারেটিভ বা স্নায়ুক্ষয়ী রোগের মাঝে একটি। এই রোগে আক্রান্তদের স্মৃতিশক্তি ও মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে। মেডিটেরিয়ান ডায়েটে অভ্যস্ত এক দল মানুষের উপরে গবেষণায় অলিভ অয়েলের উপকারিতা সাব্যস্ত হয়েছে।

৬. ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে:

বিভিন্ন অসুখের মতো ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণেও Olive Oil কার্যকর ভূমিকা পালন করে। কিছু গবেষণা দ্বারা এটি প্রমাণিত যে,এই তেল ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে এবং ইনসুলিন সেনসিটিভিটি নিশ্চিতকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যুক্তরাষ্ট্রে সংঘটিত আরোও একটি রিসার্চে দেখা যায়, Olive Oil সেবনকারী নারীদের তুলনায় এই তেল ব্যবহার না করা নারীদের ডায়াবেটিস হওয়ার হার বেশি।

৭. কোষ্ঠকাঠিন্য নিরাময়ে:

কোষ্ঠকাঠিন্যের প্রতিকার হিসেবে Olive Oil ব্যবহার করা যেতে পারে। Olive Oil গ্যাস্ট্রো-ইনটেস্টাইনাল ট্র্যাক্ট এবং কোলনের জন্য উপকারী। এই তেল এর গাঠণিক বৈশিষ্ট্য পরিপাকতন্ত্রকে উদ্দীপিত করতে সাহায্য করে, যার ফলে খাবার কোলনের মধ্য দিয়ে মসৃণভাবে চলাচল করতে পারে। এর ফলে কোষ্ঠকাঠিন্য নিরাময় হয়।

Olive Oil মনোস্যাচুরেটেড ফ্যাট সমৃদ্ধ । এটি গতিশীলতা বাড়াতে সাহায্য করে যাতে খাবার কোন সমস্যা ছাড়াই কোলনের মধ্য দিয়ে যেতে পারে। এটি অন্ত্রের নিষ্কাশনকে দ্রুত করতে সাহায্য করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ করে।

৮. পাকস্থলীর সুস্থতায়: 

এই তেল ভিটামিন ই এবং কে, আয়রন, ওমেগা -3 এবং 6 ফ্যাটি অ্যাসিড এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ। এর ফলে এটি প্রমাণিত হয় যে, এন্টিঅক্সিডেন্ট ক্ষতিকারক যৌগগুলিকে ডিটক্সিফিকেশনে সহায়তা করে। এই পুষ্টি উপাদানগুলো পাচনতন্ত্র সহ সামগ্রিক স্বাস্থ্যের উন্নতি করে এবং সেই সাথে পাকস্থলীর সমস্যা রোধ করতে সহায়তা করে।

৯. স্ট্রোক প্রতিরোধে: 

অনেকে জেনে অবাক হবেন যে, দৈনিক এক্সট্রা ভার্জিন অয়েল গ্রহণ স্ট্রোক প্রতিরোধে সাহায্য করতে পারে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে বয়স্ক ব্যক্তিরা তাদের খাদ্যতালিকায় অলিভ অয়েল গ্রহণ করেন তাদের স্ট্রোকের ঝুঁকি ৪১% কম।

আমরা সকলেই জানি যে, মস্তিষ্কের সাথে সংযোগকারী রক্তনালীতে রক্ত ​​​​জমাট বাঁধার কারণে স্ট্রোক ঘটে, যা মস্তিষ্কের ক্ষতি এবং শেষ পর্যন্ত মৃত্যু পর্যন্ত ঘটাতে পারে। Olive Oil এই জমাট বাঁধা রক্তকে পাতলা করতে সাহায্য করে, মস্তিষ্কে সঠিক রক্ত ​​​​প্রবাহ নিশ্চিত করে।

১০. ব্রেস্ট ক্যান্সার প্রতিরোধে:

শুনতে অদ্ভুত মনে হলেও Olive Oil এবং স্তন ক্যান্সারের মাঝে বিপরীতমুখী সম্পর্ক রয়েছে। বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গিয়েছে, এতে এন্টি কার্সিনোজেনিক উপাদান রয়েছে অর্থাৎ এই সকল উপাদান স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে। এন্টি কার্সিনোজেনিক হলো সেই সকল উপাদান যা ক্যান্সারে বিরুদ্ধে কাজ করে।

সৌদি আরবে সম্পন্ন একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, অলিভ অয়েলে oleuropein নামের রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে। এই পদার্থটি ক্যান্সার প্রতিরোধে ভূমিকা পালন করে। একই সাথে স্পেনে সম্পন্ন একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছ,  যে নারীরা প্রতিদিন Olive Oil দিয়ে রান্না করা খাবার গ্রহণ করে তাদের ব্রেস্ট ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি ৬২ শতাংশ কম।

অলিভ অয়েলের সমালোচনা: 

কিছু মানুষ এই তেলে ওমেগা-৩ এর তুলনায় থেকে ওমেগা-৬ বেশি অনুপাতে থাকার জন্য অলিভ অয়েলের সমালোচনা করেছেন। অনেকে এই কারণে এই স্বাস্থ্য উপকারিতা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেন।

কিন্তু এই তেলে মোট পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কম। এই কারনে এই ধরণের চিন্তা অনেকটাই অমুলক। 

উপরোক্ত আলোচনা থেকে এই বিষয়টি প্রতিয়মান যে, অলিভ অয়েল একটি স্বাস্থ্যকর ভোজ্যতেল। এর স্বাস্থ্য উপকারিতা অনেক এবং শরীরে বিভিন্ন রকমের উপকার করে থাকে। হৃদরোগের সমস্যায় ভোগা মানুষের জন্য এটি পথ্য হিসেবে ব্যবহার করা হলেও, সচেতন উপায়ে সকলের জন্য সব সময় ব্যবহার একটি সুস্থ জীবন নিশ্চিত করতে পারে।