ইনফ্লামেশন বা প্রদাহ এমন একটি শব্দ যা আমরা প্রায়শই স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিষয়ক বিভিন্ন ক্ষেত্রে শুনে থাকি। বিভিন্ন রকমের স্বাস্থ্য সমস্যাকে বর্ণনা করতে এই শব্দটি ব্যবহার করা হয়। ছোট কিংবা বড়, ইনফ্লামেশন যেমনই হোক না কেনো তার চিকিৎসা গ্রহন না করা হলে তা মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে।
ইনফ্লামেশন বা প্রদাহ কি?
ইনফ্লামেশন বা প্রদাহ হল আঘাত, সংক্রমণ বা অসুস্থতা প্রকাশ করার জন্য ইমিউন সিস্টেমের একটি স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। এটি একটি জটিল জৈবিক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে শরীরের ইমিউন সিস্টেম, রক্তনালী এবং বিভিন্ন কোষ টিস্যুর ক্ষয়কে প্রকাশ করে।
যখন শরীর আহত হয়, সংক্রমিত হয় কিংবা ক্ষতিকারক পদার্থের সংস্পর্শে আসে, তখন ইমিউন সিস্টেম শ্বেত রক্তকণিকা এবং অন্যান্য Chemical Messenger কে প্রভাবিত এলাকায় প্রেরন করে। এরপরে এই পদার্থগুলো প্রদাহ তৈরি করার মাধ্যমে জায়গাটিকে শনাক্ত করে। যার ফলে মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা এই সমস্যার বিপক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।
নিচে এমন কিছু ইনফ্লামেশনের কথা উল্লেখ করা হলো যেগুলো আমরা প্রতিনিয়তই শুনে থাকি:
- Hepatitis
- Meningitis
- Arthritis
- Nephritis
- Conjunctivitis
- Broncitis
- Tonsillitis
- Sinusitis
- Parcreaitis
বিভিন্ন রকমের টিউমর, ক্যান্সার, আলসারও দীর্ঘ মেয়াদে ইনফ্লামেশন প্রকাশ করে। কোনো অসুখের নামের শেষে “-itis” যুক্ত থাকলে বুঝে নিতে হবে তা একটি ইনফ্লামেশন।
কিভাবে প্রদাহ ঘটে?
প্রদাহ ঘটে যখন ইমিউন সিস্টেম শরীরে আঘাত, সংক্রমণ বা বহিরাগত পদার্থ শনাক্ত করে। ইমিউন সিস্টেম এই সময় Histamin, Prostaglandin এবং Cytokinin এর মতো নিউরোট্রান্সমিটার নির্গত করে সাড়া প্রদান করে। এই রাসায়নিক পদার্থসমূহ রক্তনালীগুলিকে প্রসারিত করে, যা প্রভাবিত এলাকায় রক্ত প্রবাহ বাড়িয়ে তোলে। যার ফলে ইনফ্লামেশনের লক্ষণ সমুহ প্রকাশ পায়।
ইনফ্লামেশনের লক্ষণ:
প্রদাহের কিছু চিহ্ন ও লক্ষণ রয়েছে। প্রধানত চারটি লক্ষণ দেখা দিলে আমরা নিশ্চিত হতে পারি কোনো একটি স্থানে ইনফ্লামেশন হয়েছেঃ
- লাল ভাব (Redness)
- ফুলে যাওয়া (Swelling)
- তাপ তৈরি হওয়া (Heat Generation)
- ব্যথা (Pain)
তবে কারো কারো ক্ষেত্রে আরো একটি অতিরিক্ত চিহ্ন দেখা দেয়। তা হলো আক্রান্ত জায়গাটি তার কর্মক্ষমতা (Loss of Function) হারিয়ে ফেলে।
প্রদাহের প্রকারভেদ (Types of Inflammation)
ইনফ্লামেশনকে প্রধাণত দুইভাগে ভাগ করা যায়:
- Acute এবং
- Chronic
1. Acute Inflammation
Accute Inflammation হল আঘাত বা সংক্রমণের জন্য ইমিউন সিস্টেমের একটি স্বল্পমেয়াদী প্রতিক্রিয়া। এটি সাধারণত কয়েক দিন স্থায়ী হয় এরপরে সুস্থতার দিকে চলে যায়। তবে অনেকক্ষেত্রে দ্রুত অবস্থা খারাপের দিকে যেতে পারে। যেমন: Tonsillitis.
2. Chronic Inflammation
Chronic বা দীর্ঘস্থায়ী Inflammation হল আঘাত বা সংক্রমণের প্রতি ইমিউন সিস্টেমের দীর্ঘমেয়াদী প্রতিক্রিয়া। এটি কয়েক মাস বা এমনকি বছর ধরে স্থায়ী হতে পারে এবং বাত, হৃদরোগ এবং ক্যান্সার সহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা থেকে তৈরি পারে। যেমন: Arthritis.
প্রদাহের সাধারণ কারণ
Inflammation বিভিন্ন কারণের কারণে হতে পারে, যার মধ্যে রয়েছে:
- সংক্রমণ: ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাল এবং ছত্রাকজনিত সংক্রমণ এই ধরণের শারীরিক সমস্যা শুরু করতে পারে।
- আঘাত: শারীরিক আঘাত, যেমন কাটা, ক্ষত এবং পোড়া থেকে Inflammation হতে পারে।
- টক্সিন: পরিবেশগত বিষাক্ত পদার্থের সংস্পর্শে (যেমন দূষণকারী, রাসায়নিক এবং ভারী ধাতু) প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে।
- স্ট্রেস: দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপ ইমিউন সিস্টেমকে সক্রিয় করে প্রদাহ তৈরি করতে পারে।
- খারাপ ডায়েট: প্রক্রিয়াজাত খাবার, পরিশোধিত চিনি এবং অস্বাস্থ্যকর চর্বিযুক্ত খাবার খাওয়া প্রদাহকে বাড়িয়ে তুলতে পারে।
ইনফ্লামেশন তৈরি করে এমন খাবার
কিছু খাবার শরীরে Inflammation বাড়াতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে:
- চিনি: অত্যধিক চিনি খাওয়ার ফলে রক্তে শর্করার মাত্রা বৃদ্ধি এবং ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স এর কারণে Inflammation হতে পারে।
- প্রক্রিয়াজাত খাবার: প্রক্রিয়াজাত খাবারে প্রায়শই অস্বাস্থ্যকর চর্বি, পরিশোধিত শর্করা বেশি থাকে, এগুলি সবই এই শারীরিক সমস্যাকে বাড়িয়ে তুলতে পারে।
- ট্রান্স ফ্যাট: ট্রান্স ফ্যাট ভাজা খাবার, বেকড পণ্য এবং প্রক্রিয়াজাত স্ন্যাকসে পাওয়া যায়। এগুলো শরীরে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস এবং প্রদাহ বাড়িয়ে তোলে।
- অ্যালকোহল: অত্যধিক অ্যালকোহল পান করলে লিভারের ক্ষতি করে এবং অক্সিডেটিভ স্ট্রেস বাড়িয়ে Inflammation হতে পারে।
- ভাজা খাবার: ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, ফ্রাইড চিকেন এবং ভাজাপোড়া ট্রান্স ফ্যাট বেশি থাকে, যা এই ধরণের শারীরিক সমস্যা বাড়াতে পারে।
- প্রক্রিয়াজাত মাংস: প্রক্রিয়াজাত মাংস যেমন গরুর মাংস, এবং সসেজে প্রচুর পরিমাণে স্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকে, যা Inflammation বাড়াতে পারে।
- পরিশোধিত কার্বোহাইড্রেট: সাদা আটা, সাদা চিনি, পাস্তা এবং পেস্ট্রির মতো পরিশোধিত কার্বোহাইড্রেট রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়িয়ে তোলে। যার ফলে ইনফ্লামেশন বেগপ্রাপ্ত হয়।
- কৃত্রিম সুইটনার: Aspartame এবং Sucralose এর মতো কৃত্রিম সুইটনার গুলি Gut Flora এর মাঝে পরিবর্তন আনে। এর ফলে ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধি হয় যারা Inflammation সৃষ্টি করতে পারে।
প্রদাহ থেকে বাঁচার উপায়
আমরা কিছু সাধারণ নিয়ম পালন করে এই ধরনের শারীরিক সমস্যা থেকে দূরে থাকতে পারি। নিচে কিছু উপায় দেওয়া হলো:
স্বাস্থ্যকর ডায়েট:
ফল, শাকসবজি, হোল গ্রেইন এবং স্বাস্থ্যকর চর্বি সমৃদ্ধ একটি স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া শরীরের Inflammation কমাতে সাহায্য করতে পারে। এই খাবারগুলিতে এন্টিঅক্সিডেন্ট ও এন্টিইনফ্লামেটরি উপাদান বেশি থাকে, যা অক্সিডেটিভ স্ট্রেস এবং Inflammation থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করতে পারে।
নিয়মিত ব্যায়াম:
নিয়মিত শরীর চর্চা রক্ত সঞ্চালন উন্নত করে, স্ট্রেস কমাতে এবং প্রদাহ-বিরোধী হরমোন তৈরি করতে সাহায্য করে।
স্ট্রেস কমানো:
দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপ এই শারীরিক সমস্যার দিকে নিয়ে যেতে পারে। তাই স্ট্রেস পরিচালনা করার উপায় খুঁজে বের করা গুরুত্বপূর্ণ।
টক্সিন এড়িয়ে চলা:
পরিবেশে বিদ্যমান বিভিন্ন টক্সিনগুলি ইনফ্লামেশনসহ নানা রকমের দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা তৈরি করতে পারে। তাই ক্ষতিকারক পদার্থ যেমন দূষণকারী, রাসায়নিক সার, কীটনাশক, ভারী ধাতু (আর্সেনিক, ক্যাডমিয়াম, সিসা) গুলির সংস্পর্শ এড়ানো গুরুত্বপূর্ণ।
পর্যাপ্ত ঘুমানো:
ঘুমের অভাব অক্সিডেটিভ স্ট্রেস বাড়িয়ে তোলে। এটি ইমিউন সিস্টেমকে সক্রিয় করে প্রদাহ তৈরি করতে পারে। প্রতি রাতে কমপক্ষে ৬-৮ ঘন্টা ঘুমানো জরুরি।
ইনফ্লামেশন আমাদের শরীরের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। আমরা একে অনেকক্ষেত্রে রোগ হিসেবে গণ্য করে থাকি। কিন্তু এটি কোনো অসুখ না, এটি মুলত রোগের লক্ষণ। এই কারনে অসুখভেদে এই শারীরিক সমস্যার গতি ও প্রকৃতি ভিন্ন হতে পারে। আমরা সুষম খাদ্য গ্রহণ, শরীর চর্চা, স্ট্রেস কমানো ইত্যাদি উপায়ে এই শারীরিক সমস্যা থেকে দূরে থাকতে পারি।