আপেল সিডার ভিনেগারের উপকারিতা

বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যার জন্য দীর্ঘকাল থেকেই আপেল সিডার ভিনেগার প্রাকৃতিক প্রতিকার হিসাবে ব্যবহার হয়ে আসছে। ইদানিং এটিকে একটি নতুন আবিষ্কার বলে মনে করা হলেও আসলে এটি একটি প্রাচীন প্রতিকারক। যদি সঠিক ভাবে বলতে হয় তবে এটি একটি পুনঃআবিষ্কার। 

স্বাস্থ্যকর এবং প্রাকৃতিক উপায়ে জীবন ধারণের চেষ্টা করা মানুষের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পেয়ে যাচ্ছে। স্বাস্থ্যসচেতন এই সকল মানুষের স্বাস্থ্যবিষয়ক আলোচনায় বার বার করেই এই ভিনেগারের কথা উঠে আসে।

আপেল সিডার ভিনেগার (Apple Cider Vinegar) কি? 

এবার জেনে নেওয়া যাক, আপেল সিডার ভিনেগার আসলে কি?

আপেল সিডার ভিনেগার হলো আপেল থেকে তৈরি এক ধরনের ভিনেগার যা সুস্বাস্থ্যের জন্য একটি অত্যন্ত উপকারি পানীয় বিশেষ।

আরোও নির্দিষ্টভাবে বলতে হলে,

Apple Cider Vinegar হলো ফার্মেন্টেশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রাপ্ত আপেলের রস। এই প্রক্রিয়ায় দুইবার ফার্মেন্টেশন করা হয়। কারণ প্রথম পর্যায়ে এতে এলকোহল থাকে, পরের ধাপে আর কোনো এলকোহল অবশিষ্ট থাকে না। 

আপেল সিডার ভিনেগারের ব্যবহারের নিয়ম:

আপেল সিডার ভিনেগার গাঢ় তরল জাতীয়। এটিকে পাতলা করে সেবন করতে হয়। সাধারণত এক গ্লাস পানিতে এক টেবিল চামচ পরিমাণ আপেল সিডার ভিনেগার নেওয়া হয় এবং পাতলা করা হয়।

প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে এবং রাতে খাওয়ার পর ঘুমানোর আগে এটি সেবন উত্তম। চাইলে দিনে তিনবারও সেবন করা যায়। তবে মনে রাখতে হবে, ১৫ থেকে ৩০ মিলিলিটার এর বেশি সেবন করলে শারীরিক অস্বস্তি দেখা দিতে পারে।

এছাড়াও এটিকে ত্বকের এবং চুলের সৌন্দর্য চর্চায় ব্যবহার করা হয়ে থাকে। 

আপেল সিডার ভিনেগারের পুষ্টিতথ্য 

আপেল সিডার ভিনেগার পুষ্টির বিশাল সংগ্রহশালা। এটির পুষ্টি উপাদানের তালিকা দেখে নেওয়া যাক। 

Apple Cider Vinegar এ রয়েছে: 

  • ম্যাগনেসিয়াম 
  • আয়রণ
  • ফসফরাস 
  • ম্যাঙ্গানিজ 
  • অ্যামিনো অ্যাসিড
  • অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট
  • ক্যালরি

অর্থাৎ বিভিন্ন রকম খনিজের বিশাল উৎস এটি। একই সাথে এটি গ্রহণের ফলে ক্যালোরি গ্রহণে তেমন পার্থক্য হয় না বললেই চলে। এই কারণে অতিরিক্ত ক্যালোরি গ্রহণ কিংবা ক্যালোরি নিয়ন্ত্রণের চিন্তা বাদ দিয়ে এটি খাওয়া সম্ভব।

আপেল সিডার ভিনেগারের উপকারিতা

আপেল সিডার ভিনেগারের অসংখ্য উপকার রয়েছে। এর কিছু গবেষনা দ্বারা প্রমাণিত এবং কিছু অনুমেয়। নিচে এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:

১. ওজন কমাতে সহায়তা:

আপেল সিডার ভিনেগারের সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যবহার হলো ওজন নিয়ন্ত্রণে। শরীরের অতিরিক্ত ওজন কমাতে স্বাস্থ্যসচেতন মানুষ এটি গ্রহণ করে অনেক উপকার লাভ করছে।

যেকোনো অবস্থাতে এটি গ্রহণ করলেই তা ওজন কমাতে সাহায্য করে। কিন্তু একটি পরিপূর্ণ নিয়মতান্ত্রিক জীবনব্যবস্থার মাঝে চললে এর থেকে আরোও ভালো ফলাফল পাওয়া সম্ভব।

ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং কিংবা লো কার্ব ডায়েট সহ বিভিন্ন ডায়েট প্লানের সাথে খুব সহজেই এই ভিনেগার ব্যবহার করা সম্ভব। এটি আহারের পূর্ণতার অনুভূতি বৃদ্ধি করে। এর ফলে অতিরিক্ত খাবার গ্রহণ করার পরিমাণ কমে আসে।

২. অন্ত্রের সুরক্ষায়:

Apple Cider Vinegar একটি ফার্মেন্টেটেড খাবার। এর অর্থ হলো এতে প্রচুর পরিমাণে প্রোবায়োটিক রয়েছে। প্রোবায়োটিক আমাদের অন্ত্রের স্বাস্থ্যকে সুস্থ রাখে। হজম প্রক্রিয়াকে সহজ করে।

একই সাথে, এটি মানবদেহের গাট ফ্লোরার জন্য ভালো। গাট ফ্লোরা হলো মানবদেহে উপকারী অনুজীবের সংমিশ্রণ যা আমাদের অন্ত্রে বাস করে এবং নানা রকম উপকার সাধন করে।

৩. হজমে সহায়তা প্রদান: 

আমরা আগেই জেনেছি, ACV ড্রিঙ্কস হজম প্রক্রিয়াকে সহজ করে। এটি সেবনের ফলে,

  • বুকে জ্বালাপোড়া অনুভূতি হ্রাস পায়। 
  • পেট ফাপা কমে যায়। 
  • গুরুপাক জাতীয় খাবার হজম সহজ হয়।

খাবার গ্রহণের পর পরই বুক জ্বলা ভাব, অস্বস্তি কিংবা ব্যথা অনুভূত হওয়া স্বাভাবিক কোনো ব্যাপার নয়। এমনটা হওয়ার অর্থ হলো পরিপাকজনিত সমস্যা। ACV ড্রিঙ্কস এই ধরণের সমস্যার বিপক্ষে কাজ করে।

৪. ডায়াবেটিস, হৃদরোগ ও উচ্চরক্তচাপ প্রতিরোধ: 

আপেল সিডার ভিনেগার বিভিন্ন অসুখ প্রতিরোধে কাজ করে। পরিপাক প্রক্রিয়া সচল ও মসৃণ রাখার মাধ্যমে রক্তের শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে মুখ্য ভূমিকা রাখতে পারে। এর ফলে বিভিন্ন হরমোনের ভারসাম্য রক্ষা হয়। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে। একই সাথে কোষের ইনসুলিন সেন্সিটিভিটি বৃদ্ধি করে।

ওজন হ্রাস হওয়ার ফলে শরীরে অতিরিক্ত কোলেস্টেরল জমতে পারে না। এর ফলে কমে যায় উচ্চ রক্তচাপের ঝুকি। একই সাথে এর ফলে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবণাও কমে যায়।

৫. এন্টি-ব্যাকটেরিয়াল গুণাবলি সমৃদ্ধ: 

আপেল সিডার ভিনেগার এন্টি-ব্যাক্টেরিয়াল গুণাবলি সম্পন্ন। খাবার হিসেবে গ্রহণ করা ছাড়াও এটিকে ক্ষত পরিষ্কার করতে ব্যবহার করা যায়। যদিও এই উপায়ে ব্যবহারের পরিমাণ এখন অনেক কমে গিয়েছে।

কিন্তু ব্যকটেরিয়া ও ছত্রাকরোধী গুণাবলির কারণে এটিকে প্রাকৃতিক প্রিজারভেটিভ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। একই সাথে এটি বিভিন্ন প্রদাহ ও ইনফেকশন রোধেও কাজ করে থাকে।

৬. ক্যান্সার প্রতিরোধে:

অনেক স্বাস্থ্যকর খাবারের মতো আপেল সিডার ভিনেগার ক্যান্সার প্রতিরোধে অবদান রাখে। একই সাথে এটি ক্যান্সার কোষ বিভাজনের হারকে কমিয়ে আনে।

তবে এই ব্যাপার মাথায় রাখা জরুরি, ACV ক্যান্সারের চিকিতসায় সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। অবশ্যই প্রথাগত চিকিৎসার বিকল্প নয়।

একই সাথে এতে এন্টি এক্সিডেন্ট রয়েছে। এন্টি অক্সিডেন্ট ফ্রি র‍্যাডিকেলকে নিষ্ক্রিয় করে। ফ্রি র‍্যাডিক্যাল ক্যান্সার, বার্ধক্য, ইনফ্লামেশনসহ বিভিন্ন রোগের অন্যতম কারণ।

৭. ত্বক ও চুলের যত্নে:

সৌন্দর্য চর্চা আরোও একটি ক্ষেত্র যেখানে এই ভিনেগারটির জনপ্রিয়তা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিয়মিত ব্যবহারে ত্বক লাবণ্যময় হয় এবং চুলও সিল্কি হয়ে উঠে।

এর গুণাবলি এখানেই শেষ না। ACV পানীয় নিন্মোক্ত উপায়ে ত্বক এবং চুলের উপকার করে থাকে।

  • ব্রণের প্রকোপ হ্রাস করে; 
  • ত্বকের রোদে পোড়াভাব  প্রশমিত করে; 
  • এর এন্টি এজিং বৈশিষ্ট্য আছে; 
  • চুলের স্বাস্থ্যের উন্নতি করে; 
  • চুলের জট বাধা মোকাবেলা করে; 
  • চুল কোঁকড়ানো কমায়; 
  • চুলের কিউটিকলকে ধরে রাখে  
  • চুলকে আর্দ্রতা ধরে রাখতে সাহায্য করে; 
  • খুশকির চিকিৎসা করে

৮. কোষ্ঠকাঠিন্য দূরীকরণ:

আপেল সিডার ভিনেগার প্রাকৃতিক ল্যাক্সেটিভ অর্থাৎ এটি মলকে পিচ্ছিল করে এবং মলত্যাগের প্রক্রিয়াকে সহজ করে তোলে। যাদের কোষ্ঠকাঠিন্যের মতো সমস্যা রয়েছে তাদের জন্য এটি একটি ভালো পথ্য হতে পারে।

৯. এমাইনো এসিডের উৎস:

এমাইনো এসিড আমাদের শরীরে অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। ডিএনএ এবং আরএনএ এর সঠিক নিয়ন্ত্রণ, প্রোটিন তৈরি, রাইবোসোমকে সচল রাখা, কোষ বৃদ্ধি ও বিভাজন, প্রজনন প্রভৃতি কাজে এই উপাদানের কোনো বিকল্প নেই। এটি ছাড়া আমাদের শরীর অচল। আপেল সিডার ভিনেগার বিভিন্ন এমাইনো এসিডের গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

সতর্কতা:

আপেল সিডার ভিনেগার অ্যাসিডিক হওয়ায় এটিকে পাতলা না করে পান করা মোটেও উচিত না। নির্দিষ্ট পরিমাণ পানি মিশালে এই ভিনেগারের এসিডিটি কমে যায়। অতিরিক্ত অম্লতা থেকে নিমোক্ত সমস্যাসমুহ হতে পারে:

  • দাঁতের ক্ষয় - অতিরিক্ত এসিডিক দ্রবণ দাতের ক্ষয় করে এবং দাঁতের এনামেল দুর্বল করে দেয়। 
  • পটাসিয়ামের মাত্রা কমে যাওয়া - যখন প্রয়োজনের চেয়ে বেশি মাত্রায় ACV ড্রিঙ্কস পান করা হয় তখন শরীরে পটাসিয়ামের মাত্রা কমতে শুরু করে।
  • বদহজম - অত্যধিক ACV ড্রিঙ্কস গ্রহণে বদহজম হতে পারে। 
  • পরিপাকজনিত সমস্যা - এটি বিপরীতমুখী শোনালেও যাদের আলসার বা অ্যাসিড রিফ্লাক্স আছে তাদের জন্য এটি ঐ সকল অসুখের লক্ষণগুলিকে আরোও খারাপ করবে।
  • ত্বক পুড়ে যাওয়া - আপেল সিডার ভিনেগার রোদে পোড়া ভাবকে প্রশমিত করতে পারে কিন্তু যদি এটিকে পাতলা করে ত্বকে লাগানো না হয় তবে এটি  ত্বককে উলটো পুড়িয়ে ফেলতে পারে।

আপেল সিডার ভিনেগার একটি স্বাস্থ্যকর খাবার পানীয় । এটি আমাদের পরিপাক, হৃদযন্ত্র, ত্বক ও চুলের জন্য খুবই উপকারি। অনেক খণিজ উপাদানে সমৃদ্ধ এই খাবারটি আমাদের শরীরের অনেক ক্ষয় রোধ করে, অসুখ হতে বাধা প্রদান করে। আমরা চেষ্টা করবো ব্যবহারবিধি মেনে চলে এটিকে ব্যবহার করতে এবং শারীরিক সুস্থতা অর্জনে একধাপ এগিয়ে যেতে।