একটি প্রবাদ আছে “স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল”। দৈনন্দিন জীবনকে সুন্দর করতে হলে আমাদের নানা রকমের পরিস্থিতির মাঝে দিয়ে যেতে হয়। নানা রকমের স্বাস্থ্যঝুঁকি এর ভিতরে অন্যতম। ব্যবহারিক এবং উপযুক্ত স্বাস্থ্যশিক্ষাই পারে আমাদেরকে অনেক স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে বাঁচিয়ে দিতে।
স্বাস্থ্য শিক্ষা বলতে কি বুঝায়?
স্বাস্থ্য শিক্ষা বলতে সেই জ্ঞানকে বুঝায় যা অর্জন করলে আমরা নিজেদের নানা রকমের রোগ কিংবা অসুস্থতা থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারি। এই শিক্ষার ফলে আমাদের স্বাস্থ্যের উন্নতির রাস্তা খুঁজে বের করতে পারি, কি ধরণের খাবার আমাদের জন্য ভালো, কোন অভ্যাসগুলো দরকারি এগুলো জানতে পারি। মোদ্দাকথা সুস্থ থাকার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞানই হলো স্বাস্থ্যশিক্ষা।
WHO এর ভাষ্যমতে,
“Health Education aims creating such quality of life as may enable an individual to live long and serve best.”
অর্থাৎ, স্বাস্থ্য শিক্ষার লক্ষ্য হলো একজন মানুষের জীবনযাত্রার মানের উন্নতি ঘটিয়ে তাকে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যেন সে সুস্থভাবে বাঁচতে পারে এবং মানুষের উপকারে অবদান রাখতে পারে।
স্বাস্থ্য শিক্ষার গুরুত্ব:
স্বাস্থ্যশিক্ষার প্রতি এতটা গুরুত্ব দেওয়ার পেছনে নিশ্চয়ই কিছু কারণ রয়েছে। আমরা কিছু প্রয়োজনীয়তা একটু চিন্তা করলেই বলে দিতে পারি। আবার কিছু প্রয়োজনীয়তা বুঝতে আমাদের ভালো ধারনা রাখা প্রয়োজন।
১. সুস্থতা অর্জনে:
আমরা প্রতিদিন নানা রকমের রোগ-জীবানুর সংস্পর্শে আসি। নানা রকম স্বাস্থ্যঝুকির মাঝে পড়ে যাই। কিন্তু স্বাস্থ্যশিক্ষা থাকলে আমরা কখন কীভাবে সতর্ক থাকবো তা নিয়ে ধারণা রাখতে পারবো।
২. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি:
আমাদের প্রতিদিনের নানা রকমের ভালো অভ্যাস যেমনঃ সকাল ঘুম থেকে ওঠা, পুষ্টিকর খাবার খাওয়া ইত্যাদি আমাদের শারীরিক অবস্থাকে প্রভাবিত করে। এই প্রভাব আমাদের শরীরকে অসুখের বিরুদ্ধে লড়তে সাহায্য করে। আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
৩. মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে:
একটা সুস্থ শরীরে সুস্থ মন বাস করে। এই কথাকে একটা প্রবাদ মনে করে গুরুত্ব না দিলে ভুল হবে। আমাদের মানসিক অবস্থা আমাদের শারীরিক অবস্থার সাথেও তপ্রতভাবে জড়িত। তাই স্বাস্থ্যশিক্ষা করে আমরা জানতে পারি কীভাবে আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকবে।
৪. মনোযোগ বৃদ্ধি:
আমাদের এখনকার বাবা মার ভিতরে একটি বিষয় দেখা যায়। তারা তাদের সন্তানদের শারীরিক পরিশ্রম ও মাঠের খেলাধুলার প্রতি খুব উদাসীন। তারা যদি স্বাস্থ্য শিক্ষাতে মনোযোগী হতো তাহলে তারা জানতেন যে যেসব বাচ্চা শারীরিক শ্রম করে কিংবা খেলাধুলা করে তারা দীর্ঘ সময় মনোযোগ ধরে রাখতে পারে। একই সাথে এটি তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং হাড়ের গঠনে সাহায্য করে।
৫. শারীরিক ও মানসিক বিকাশ লাভ:
বিশ্বায়নের এই যুগে আমরা যখন সব কিছুই ঘরে বসেই পাচ্ছি তখন কমে আসছে কায়িক শ্রমের প্রবণতা যা আমাদের নিয়ে যাচ্ছে নানা রকমের শারীরিক ও মানসিক সমস্যার দিকে। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এই ভয়াবহ অবস্থাতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। স্বাস্থ্য শিক্ষায় শিক্ষিত হলে আমরা নিজেরা শারীরিক ও মানসিক বিকাশে কি কি করতে হবে এ নিয়ে সচেতন হবো, অন্যদের সচেতন করতে পারবো।
৬. দীর্ঘায়ু লাভ করতে:
মানুষ মরণশীল কিন্তু মানুষ বেচে থাকতে চায় অনেকদিন। মানুষ সব সময়ই অমরত্বের সন্ধান করে গিয়েছে। যদিও তা অর্জন সম্ভব হয় নি কিন্তু আমরা আমাদের আয়ু আসলেই বাড়িয়ে নিতে স্বাস্থ্য শিক্ষার মাধ্যমে। অসুখ থেকে দূরে থেকে, জীবনযাপনের মান বাড়িয়ে মানুষ সুস্থভাবে দীর্ঘদিন বেচে থাকতে পারে।
৭. স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধিতে:
আমাদের মাঝে এমন অনেকেই আছে যারা স্বাস্থ্যঝুকি সম্পর্কে অনেকে কিছুই জানেন। কিন্তু তারপরেও সতর্ক হন না। যেমনঃ প্রায় সকল ধুমপায়ী জানেন এটা ক্ষতিকর, কিন্তু তাও তারা সতর্ক হয় না। অনেকেই বুঝেন তাদের ওজন কমানো দরকার, কিন্তু তারা এই দিকে গুরুত্ব দিতে চান না। এটাই হলো সতর্কতার অভাব। স্বাস্থ্য শিক্ষা ধীরে ধীরে এই মানুষগুলোর মাঝে সচেতনতা তৈরি করতে পারে। একটা সময় তারা তাদের সমস্যাগুলো নিয়ে সচেতন হবেন এবং সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসবেন।
৮. অর্থনৈতিক সমৃদ্ধতা অর্জনে:
আধুনিকযুগে চিকিৎসা ব্যয়বহুল। প্রতি নিয়ত নিত্যনতুন চিকিৎসা এবং ঔষধের খরচ বেড়ে চলেছে। এই ব্যয় থেকে বেচে থাকার একটি মাত্র উপায়। আর তা হলো সুস্থ্য থাকা। আরো একটি বিষয় প্রতিদিন আমরা নানা রকমের বাজে খরচ করে থাকি। সিগারেট, এলকোহল, ফাস্ট ফুড ইত্যাদি খরচ সাপেক্ষ। সঠিক স্বাস্থ্যজ্ঞান এই সকল খরচ থেকে আমাদের দূরে রাখতে পারে। খরচ কমলে আমরা অর্থনৈতিক সমৃদ্ধতার দিকেও ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে পারবো।
স্বাস্থ্য শিক্ষার লক্ষ্য:
প্রতিটা জিনিসেরই একটা লক্ষ্য রয়েছে। নির্দিষ্ট লক্ষ্য ছাড়া কোনোকিছু থেকেই কাঙ্ক্ষিত সুবিধা লাভ করা সম্ভব না। ঠিক একইভাবে স্বাস্থ্যশিক্ষারও একটি লক্ষ্য রয়েছে।
১। সুন্দর স্বাস্থ্য অর্জন:
সামাজিকভাবে ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে সুন্দর স্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়া, স্বাস্থ্যকর জীবন-যাপন, ভালো অভ্যাস গড়ে তোলা ইত্যাদি হলো স্বাস্থ্য শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্য।
২। খারাপ অভ্যাস ত্যাগ করা:
অনেকেরই নানা রকমের বদভ্যাস রয়েছে। কেও হয়ত দাঁত দিয়ে নখ কাটে, কেও হয়ত সিগারেট খায়, কারো হয়ত জর্দা খাওয়ার অভ্যাস আছে কিংবা কেও হয়ত অনিরাপদ যৌনসম্পর্ক করে অভ্যস্ত। একেকটি বদভ্যাসের মাত্রা যাই হোক না কেনো এগুলোর প্রতিটাই সুস্থ জীবন যাপনের অন্তরায়। এই বদভ্যাসগুলো সম্পর্কে জানা এবং এগুলো থেকে দূরে সরে আসা স্বাস্থ্যশিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য
৩। জীবন-যাপনের মানের উন্নতি:
আমাদের ভিতরে অনেকেই এমন থাকতে পারে যারা স্যানিটারি ল্যাট্রিন ব্যবহার করে না। তারা হয়ত এর অস্তিত্ব সম্পর্কে জানে কিন্তু ব্যবহারে আগ্রহ পায় না। উপযুক্ত স্বাস্থ্যশিক্ষা এই অনাগ্রহ থেকে বেড়িয়ে আসতে আমাদের সাহায্য করতে পারে। অনেকে হয়ত অতিরিক্ত তেল জাতীয় খাবার গ্রহণ করে থাকে। উপযুক্ত সচেতনতা তৈরি এই ধরণের খাবার থেকে দূরে রাখতে অবদান রাখতে পারে। দিন শেষে এর মাধ্যমে জীবন-যাপনের মানের উন্নতি অন্যতম লক্ষ্য।
৫। ব্যবহারিক প্রয়োগ:
আমরা এমন অনেক কিছুই শিখি যা আমাদের জীবনে সে ভাবে ব্যবহারিক প্রয়োজনীয়তার বাইরে। কিন্তু স্বাস্থ্য শিক্ষা এমন না। আমরা চাইলেই একে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োগ করতে পারি। যেমন: তাপ প্রয়োগে জীবাণু মারা যায় জানার পর আমরা পানি ফুটিয়ে খাই, জং ধরা লোহা দিয়ে কেটে গেলে তা থেকে ধনুষ্টংকার হতে পারে এই জ্ঞান আমাদের ভ্যাক্সিন গ্রহণে আগ্রহী করতে পারে। ছোট ছোট ব্যাপার, কিন্তু দিন শেষে এগুলোই আমাদের জীবনকে রক্ষা করতে পারে।
স্বাস্থ্য শিক্ষার উদ্দেশ্য:
স্বাস্থ্য শিক্ষাকে বলা হয় একটি সুসংহত প্রক্রিয়া। যদিও স্বাস্থ্য শিক্ষার অনেক উদ্দেশ্য রয়েছে কিন্তু সবগুলোকেই চাইলে তিনটা মূল উদ্দেশ্যে নিয়ে আসা যায়।
১। স্বাস্থ্যতথ্য প্রচার করা:
প্রতিদিন নতুন নতুন স্বাস্থ্যতথ্য আমাদের কাছে উঠে আসছে। কিন্তু সেই সকল তথ্যের কোনো দাম নেই যদি না তা মানুষকে জানানো যায়।
যেমন: কোনো একটি রোগে মানুষ প্রতিনিয়ত আক্রান্ত হচ্ছে যেমন: ডায়রিয়া। এখন মানুষকে হাত ধোঁয়ার গুরুত্ব জানাতে হবে। যদি আমরা মানুষকে এই সম্পর্কে না জানাই তবে তারা ডায়রিয়াতে আক্রান্ত হতেই থাকবে। আবার একটি খাবারের খাদ্যগুণ সম্পর্কে ধারনা সেই খাবারটি সম্পর্কে মানুষকে আগ্রহী করে তুলতে পারবে। এই জন্য যে কোনো প্রকারের স্বাস্থ্যশিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হলো মানুষের কাছে সেই তথ্য পৌঁছে দেওয়া।
২। মানুষকে আগ্রহী করে তোলা:
আমরা যদি সবার কাছে কোনো একটা ব্যাপার নিয়ে বলে আসি যে এটা ভালো কিন্তু কেনো ভালো, আর কেনো এটা পালন করা উচিৎ এ নিয়ে না জানাই তবে মানুষ কোনোদিনও আগ্রহী হবে না ।যেমন: ধরা যাক, আমরা একটা গ্রামে গিয়ে মেয়েদের জন্য স্যানিটারি প্যাড নিয়ে আগ্রহী করবো। যেহেতু এই ব্যাপারে মানুষ কথা বলতেই লজ্জা পায় সেহেতু মানুষ হয়ত আগ্রহই দেখাবে না। তখন আমাদের তাদের বুঝাতে হবে এর উপকারিতা কি? এবং এর স্বাস্থ্যঝুঁকি কি। এই যদি করানো সম্ভব হয় তবে মানুষ পর্যায়ক্রমে আগ্রহী হয়ে উঠবে।
৩। স্বাস্থ্যজ্ঞানকে কাজে লাগানো
একটা মানুষের কাছে যদি আমরা তথ্য পৌঁছে দেই এবং তাদের আগ্রহী করে তুলি তাহলেই কিন্তু কাজ শেষ হয়ে যাবে না। তারা যেন সেই কাজ করতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। রোগের জন্য হাসপাতাল লাগবে, ঔষধের জন্য ঔষধের দোকান, মাদকাসক্তদের জন্য তা নিরাময়-কেন্দ্র ইত্যাদি। এই ব্যবস্থা যদি করা সম্ভব হয় তবে মানুষ ধীরে ধীরে এই অনুযায়ী কাজ করা শুরু করবে। হয়ত শুরুতে একজন করবে, হয়ত এরপরে দুইজন কিন্তু দিন শেষে এক এক করে সচেতনতা তৈরি হবে, আরোও বেশি মানুষ এতে যুক্ত হতে থাকবে।
এই তিন হলো স্বাস্থ্য শিক্ষার প্রধান তিন উদ্দেশ্য - Informaton, Motivate, React।
সব কথার শেষ কথা, আমাদের সচেতন হতে হবে। নারী পুরুষ নির্বিশেষে আমাদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে এবং স্বাস্থ্য শিক্ষায় আগ্রহী করে তুলতে হবে।