স্বাস্থ্য বিজ্ঞান কাকে বলে? স্বাস্থ্য বিজ্ঞান এর গুরুত্ব এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাথে এর পার্থক্য

স্বাস্থ্য নিয়ে বিজ্ঞানের যেসকল শাখা কাজ করে তাই হলো স্বাস্থ্য বিজ্ঞান। আমরা সুস্থ থাকার জন্য স্বাস্থ্যশিক্ষা অর্জন করে থাকি, এই শিক্ষা নিশ্চয় নানা রকমের পরীক্ষা নিরীক্ষার পরে আমাদের সামনে উপস্থাপন করা হয়। বিজ্ঞান আমাদেরকে নানা রকমের কুসংস্কার ও স্বাস্থ্য সম্পর্কিত ভ্রান্ত ধারণা থেকে দূরে রাখে এবং এমন ধারণাগুলোকে প্রতিষ্ঠিত করে যার ভিত্তি আছে। এ নিয়ে বিজ্ঞান আরো গবেষণা করে যায়।

স্বাস্থ্যবিজ্ঞান কাকে বলে? 

স্বাস্থ্য বিজ্ঞান হলো স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিশেষ জ্ঞান। পরীক্ষা নিরীক্ষা, বিচার বিশ্লেষণ দ্বারা অর্জিত, সত্যের উপরে প্রতিষ্ঠিত, সুসংবদ্ধ স্বাস্থ্য সম্পর্কিত জ্ঞান এবং এই জ্ঞান লাভের নিমিত্তে গবেষণা করে যাওয়াই হলো স্বাস্থ্যবিজ্ঞান।

আমেরিকান পাবলিক হেলথ ইনস্টিটিউটের ভাষ্যমতে স্বাস্থ্যবিজ্ঞান হলো, 

“বিজ্ঞানের সেই শাখা যা আলোচনা করে কীভাবে রোগ প্রতিরোধ করতে হয়, কীভাবে দীর্ঘায়ু লাভ করা যায় কিংবা কীভাবে সুস্থ স্বাভাবিক জীবন উপভোগ করা যায়। এবং এই পুরো ব্যাপারটাই নিশ্চিত করা হয় ব্যক্তিগত, সম্প্রাদায়গত, সামাজিক এবং পারস্পরিক পর্যায়ে কাঠামোগত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।

স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের গুরুত্ব: 

আমরা যত বেশি গবেষণা করে যাবো তত বেশি সম্ভাবনা বাড়বে একটি নতুন ঔষধ বা ভ্যাক্সিন আবিষ্কারের। এখনো এমন অনেক রোগ আছে যার নিরাময় নেই। এখনও আমাদের শরীরের এমন অনেক রহস্য রয়েছে যার কারণ সম্পর্কে আমরা এখনো জানি না। আমাদের কাছে এখনো ধাঁধাঁর মতোই রয়েই গিয়েছে। 

খাদ্যাভ্যাস ও স্বাদ নিয়ে গবেষণা, জনসংখ্যার সাথে পাল্লা দিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধি করা, তা করতে গিয়ে প্রয়োগগত কৌশলে সুবিধা অসুবিধা সম্পর্কে জানা। অর্থাৎ এখানে আমাদের জানার শেষ নেই। সেই কারণে স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের গুরুত্বেরও শেষ নেই। নিচে এর কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হলো: 

১। সুস্থ থাকার উপায়ের সন্ধ্যান: 

শারীরবিদ্যা স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের একটি অপরিহার্য শাখা। আমাদের সুস্থ থাকতে হলে কি কি ধরণের খাবার প্রয়োজন, কি অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে, কি ধরণের ব্যায়াম করতে হবে এমন নানা বিষয় আলোচনা করার জায়গা হলো শারীরবিদ্যা। নানা রকমের ডায়েট প্ল্যান, ট্রেনিং ম্যানুয়াল তৈরি, এদের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা প্রদান, কার্যকারিতা-অকার্যকারিতা নিয়ে আলোচনা করা ইত্যাদি স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের কাজ। 

২। রোগ থেকে দূরে থাকা ও নিরাময় বের করা: 

প্রতিষেধক তৈরি আর নানা রকম অসুখের ঔষধ বের করা স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের উদ্দেশ্য। স্বাস্থ্যবিজ্ঞান এ নিয়ে গবেষণা করে, এবং হাজার হাজার বছর ধরে চলছে রোগের বিপক্ষে স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের এই লড়াই। সময়ের সাথে সাথে এটি আরো পরিণত ও নির্ভরযোগ্য হয়ে উঠেছে। একই সাথে বিকল্প ঔষধের সন্ধান, ভেষজ উপাদানের সমন্বয় ইত্যাদির জন্যও স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের গুরুত্ব বেড়ে চলেছে। 

৩। মানুষের মাঝে সচেতনতা তৈরি: 

স্বাস্থ্য বিজ্ঞানে যারা অধ্যয়ন করেছে তারা নিজেরা যেমন নানা রকম ব্যাপারে জ্ঞাত তেমনি তারা জনগণকে স্বাস্থ্যের নানা দিক নিয়ে জানাতে সক্ষম। সচেতনতা তৈরিতে এর কোনো বিকল্প নেই। 

৪। প্রতিরোধ গড়ে তুলতে: 

কথায় আছে প্রতিকার অপেক্ষা প্রতিরোধ উত্তম। এই প্রতিরোধের জন্য করণীয় ব্যাপারগুলো আমরা পেয়ে থাকি স্বাস্থ্যবিজ্ঞান থেকেই। যেমন: বিশুদ্ধ পানির প্রয়োজনীয়তা, পানিতে আর্সেনিক থাকলে ক্ষতি, হাত ধোঁয়ার প্রয়োজনীয়তা, ভ্যাক্সিনের গুরুত্ব ইত্যাদি আমরা জানতে পারি স্বাস্থ্যবিজ্ঞান দ্বারাই। এই জ্ঞান থেকে আমরা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবো। 

৫। উন্নত ব্যবস্থাপনা ও চিকিৎসাসেবা প্রদান: 

শুধু হাসপাতাল গড়ে তুললেই হবে না। তা ঠিক মতো নিয়ন্ত্রণও করতে হবে। এর উন্নতিতে কাজ করতে হবে। হাসপাতালে হাইজিনের প্রয়োজনীয়তা, হাসপাতাল থেকে তৈরি হওয়া ইনফেকশন কমানো, হাসপাতালকে নানা রকম রোগীদের ব্যবহারের উপযোগী করে তোলা, রোগীরে উপরে ভালো কিংবা খারাপ ব্যবহারের প্রভাব ইত্যাদি বিষয়ে আমরা জানতে পারি স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের মাধ্যমে। 

৬। রোগের বিস্তার নিয়ে আলোচনা: 

স্বাস্থ্য বিজ্ঞান শুধু রোগ নিয়ে আলোচনা করে না, এটি একটি রোগ কীভাবে ছড়ায়, এ থেকে কীভাবে মহামারি হতে পারে, নির্দিষ্ট রোগের জীবাণু কোন পথে শরীরে প্রবেশ করলে রোগ হবে ইত্যাদি বিষয় নিয়ে স্বাস্থ্য বিজ্ঞান আলোচনা করে। 

৭। কর্মসংস্থান গড়ে তোলা: 

স্বাস্থ্য বিজ্ঞান নতুন নতুন কাজের সুযোগ গড়ে তুলে। স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীরা নানা রকমের সচেতনতা কার্যক্রম, মেডিকেল ক্যাম্প, এনজিও থেকে শুরু করে হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, নানা খাবারের ইন্ডাস্ট্রি, ঔষধ কারখানায় চাকরি করতে পারে।

অনেক ক্ষেত্রেই এখানে ভালো সুযোগ রয়েছে উন্নতি করার। এছাড়াও নানা রকম নতুন নতুন ব্যবসার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। নতুন নতুন ইন্ট্রাপ্রেনরশীপ তৈরি হচ্ছে। দিন দিন স্বাস্থ্য সংক্রান্ত পণ্যের চাহিদাও বাড়ছে। এই সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে স্বাস্থ্যবিজ্ঞান। 

৮। ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি: 

প্রতি বছরই নতুন নতুন নানা প্রকার রোগ দেখা দেয়, যার কিছু কিছু আবার মহামারিতেও রূপ নেয়। এক ইনফ্লুয়েঞ্জা পরিবর্তিত হয়ে সার্স, সোয়াইন ফ্লু, বার্ড ফ্লু , করোনা, ওমিক্রনের মতো রোগের জন্ম দিয়েছে। সামনে এমন আরো নতুন নতুন অসুখ আসবে। একশ বছর আগেও মানুষ এইডস এর নামও জানতো না সেখানে এখন এটি অনেক দেশের মূল ঘাতকব্যাধি। এমন নতুন নতুন অসুখ বিসুখকে মোকাবেলা করতে আমাদের অবশ্যই পরিকল্পনা থাকা দরকার। এই কার্য পরিকল্পনা করার জন্য স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। 

চিকিৎসা বিজ্ঞান ও স্বাস্থ্য বিজ্ঞানের মধ্যে পার্থক্য: 

স্বাভাবিক দৃষ্টিতে চিকিৎসা বিজ্ঞান (medical Science)স্বাস্থ্য বিজ্ঞানের (Health Science) ভিতরে গভীর সম্পর্ক রয়েছে এবং এই কথাটি অস্বীকার করার কোনো উপায়ও নেই। তবে চিকিৎসাবিজ্ঞান ও স্বাস্থ্যবিজ্ঞান এক না। এদের ভিতরে কিছু পার্থক্য রয়েছে। নিচে এ নিয়ে আলোচনা করা হলোঃ 

স্বাস্থ্য বিজ্ঞান শুধুমাত্র আমাদের ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য নিয়েই চিন্তিত নয়, সামগ্রিকভাবে নানা বিষয় নিয়েও এর কাজ আছে। কমিউনিটি ওয়েলনেস, হেলথ মডিউল ডিজাইন থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো কিংবা আগের ব্যবস্থার ভিতরে পরিবর্তন, পরিবর্ধন ইত্যাদিও স্বাস্থ্য বিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়। 

অপরদিকে, একটি মানুষ কিংবা প্রাণীর সুস্থ থাকা নির্ভর করে তার মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা এবং পরিবেশ, জেনেটিক্স, সাইকোলজি, ফিজিওলজি, বায়োক্যামিকেল পাথওয়ে এবং মেটাবোলিজমের উপরে। সুস্থতা নিশ্চিতের জন্য মানুষ বা প্রাণীর ব্যক্তিগত পর্যায়ে বিজ্ঞানের যে শাখা কাজ করে থাকে তা হলো মেডিক্যাল সাইন্স কিংবা চিকিৎসা বিজ্ঞান। 

আরো একটি বিষয় নিয়ে কথা না বললেই নয়। তা হলো লাইফ সাইন্স। মেডিক্যাল সাইন্স এবং হেলথ সাইন্স দুইটারই কিছু না কিছু ভাগ লাইফ সাইন্সের মাঝে আসলেও লাইফ সাইন্স অনেক ব্যাপক। জেনেটিক্স, বায়োটেক, ফার্মাসি, মাইক্রোবায়োলজি, পাবলিক হেলথ, এপিডেমিওলজি থেকে উদ্ভিদবিদ্যা, প্রাণীবিজ্ঞান, বায়োম্যাডিকেল সাইন্স সবই লাইফ সাইন্সের বিশাল ছাতার নিচে রয়েছে। অর্থাৎ জীবন এবং জীবন সংক্রান্ত বিশাল জ্ঞানের ভাণ্ডার হলো লাইফ সাইন্স। 


নিচে চিকিৎসা বিজ্ঞান ও স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের পার্থক্য তালিকাকারে দেওয়া হলোঃ

বৈশিষ্ট্য স্বাস্থ্য বিজ্ঞান চিকিৎসা বিজ্ঞান

সংজ্ঞা

স্বাস্থ্য এবং সুস্থ্য থাকার উদ্দেশ্যে তৈরিকৃত বিজ্ঞানের শাখা 

রোগ নির্ণয়, প্রতিকার ও প্রতিরোধের জন্য নির্ধারিত বিজ্ঞানের শাখা  

লক্ষ্য

জীবনকে সুন্দর করা, সুস্থ্য রাখা 

রোগ নির্ণয়, প্রতিরোধ, প্রতিকার

শাখা- উপশাখা


জীবনের নানা পর্যায় সম্পর্কিত সুরক্ষার জন্য আলাদা আলাদা শাখা রয়েছে। যেমনঃ মহামারি নিয়ন্ত্রণে এপিডেমিওলজি, অণুজীব নিয়ে মাইক্রোবায়োলজী, পুষ্টি নিয়ে পুষ্টিবিদ ইত্যাদি


ঔষধ এবং শরীরতত্ত্ব অনুসারে আলাদা শাখায় বিভক্ত । যেমনঃ চক্ষু বিভাগ, নাক-কান-গলা বিভাগ, গাইনীকোলজিস্ট, হরমোন বিশেষজ্ঞ ইত্যাদি। 

গবেষনার বিষয়বস্তু

গবেষণার বিষয় হলো স্বাস্থ্য এবং জীবনকে সুন্দর করা , সহজ করার নানা উপায়। যেমনঃ কমিউনিটি ওয়েলনেস, স্বাস্থ্য সুরক্ষার কাঠামো তৈরি

নতুন ঔষধ এবং রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা পদ্ধতি তৈরির উপরে গবেষনা করা হয়। 

ক্যারিয়ার 

পাবলিক হেলথ, হাইজিন,  নিউট্রিশন, সাইকোলজি বায়ো-ইনফরমেটিক্স ইত্যাদি

সার্জারি, মেডিসিন, একাডেমিয়া, গবেষণা ইত্যাদি

সব কথার শেষ কথা, স্বাস্থ্য হলো সম্পদ। এইজন্য স্বাস্থ্যবিজ্ঞান হলো সেই সম্পদ লাভের বিদ্যা। আমরা নানা রকমের কৌশল অবলম্বন করি এই জীবনে অনেক সম্পদের মালিক হতে। কিন্তু সেই সম্পদ আহরণ শেষে যদি আমরা দেখি তা উপভোগ করার জন্য আমাদের সুস্বাস্থ্যই নেই, তাহলে সেই সম্পদের কোনো মুল্যই নেই। এই কারণে স্বাস্থ্যবিজ্ঞান এর মাধ্যমে ভালো থাকার কৌশল আমাদের আয়ত্ত করতে হবে আর স্বাস্থ্যশিক্ষার মাধ্যমে তা সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে।