হাইজিন বা স্বাস্থ্যবিধি বলতে কি বুঝায়? হাইজিন এর প্রকারভেদ

হাইজিন (Hygiene) বা স্বাস্থ্যবিধি কি: 

আমাদের দেশে হাইজিন শব্দটি দ্বারা স্বাভাবিক অর্থে পরিচ্ছন্নতা বুঝলেও আক্ষরিক ও ব্যবহারিক কোনো দিক থেকেই তা নয়। হাইজিন শব্দটির বাংলা হলো স্বাস্থ্যবিধি। আমাদের সুস্থ থাকার জন্য প্রয়োজনীয় নিয়ম-কানুনই হলো হাইজিন। 

WHO (World Health Organization) এর ভাষ্যমতে, 

“স্বাস্থ্যবিধি হলো সুস্থ থাকার প্রয়োজনে আরোপিত নিয়মনীতি এবং সেই নিয়মের অনুসরণ করা, যার ফলে আমরা রোগ সংক্রমণ থেকে দূরে থাকি এবং আমাদের সুস্বাস্থ্য বজায় থাকে।” 

এই হাইজিন আবার নানা রকমের হতে পারে। ব্যক্তিগত, সমষ্টিগত। আবার ব্যক্তিগত হাইজিন মানে যে এটা শুধু আমার নিজের উপকারেই আসবে এমনও না, এর সাথে আশেপাশে আর দশ মানুষেরও সংযোগ থাকতে পারে। তাই শুধুমাত্র পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার বেড়াজালের বাইরে স্বাস্থ্যবিধি খুবই বিশাল এক বিষয়। এই লেখায় হাইজিন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার চেষ্টা করবো। 

হাইজিনের প্রকারভেদ (Types of Hygiene): 

হিউম্যানিটেরিয়ান গ্লোবাল হাইজিন বা স্বাস্থ্যবিধিকে চারভাগে ভাগ করেছে। 

  1. ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি বা Personal Hygiene 
  2. পরিবেশগত স্বাস্থ্যবিধি বা Environmental Hygiene 
  3. পারিবারিক/সমষ্টিগত স্বাস্থ্যবিধি বা Domestic/ Community Hygiene 
  4. খাদ্য সংক্রান্ত স্বাস্থ্যবিধি বা Food Hygiene 

1. ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি বা Personal Hygiene: 

ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধির মাঝে চলে আসে নিজের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, কাপড়ের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, সুন্দর জীবন-যাপনের প্রণালি, খাদ্যাভ্যাস বা Diet Plan, বিশ্রামের সময়সূচী, ঘুমের পরিমাণ, শারীরিক পরিশ্রমের পরিমাণ ও ধরণ অর্থাৎ ব্যক্তিগতভাবে সুস্থ থাকার জন্য যা কিছু করার প্রয়োজন তার সবই আছে Personal Hygiene এ। 

ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধির মুল লক্ষ্য হলো আমাদের শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা বাড়ানো। আর তা করতে যা কিছু করা প্রয়োজন তার সবই Personal Hygiene.

কিছু কাজ যা Personal Hygiene এর ভিতরে রয়েছে

  • দাঁত ব্রাশ করা
  • গোসল করা
  • শরীর পরিষ্কার রাখা
  • নখ ছোট রাখা
  • নিয়মিত সুষম খাবার খাওয়া
  • প্রচুর পানি খাওয়া
  • হাঁচি-কাশির সময় রুমাল ব্যবহার
  • পরিষ্কার জামা কাপড় পড়া
  • চুল-দাড়ি গুছিয়ে রাখা

অনেকক্ষেত্রেই দেখা যায়, ব্যক্তিগত পর্যায়ে একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় Personal Hygiene মেনে না চললে মানুষ সমাজের অন্যদের কাছে ঘৃণার পাত্র, বৈষম্যের শিকার কিংবা একঘরে হয়ে যেতে পারে। একই সাথে আমরা অসুস্থও হয়ে যেতে পারি। 

2. পরিবেশগত স্বাস্থ্যবিধি বা Environmental Hygiene: 

পরিবেশগত স্বাস্থ্যবিধির প্রথম লক্ষ্যই হলো পরিবেশ যেন দূষিত না হয়, এবং পরিবেশে যেন রোগ-জীবাণু ছড়িয়ে না পড়ে। নানা রকমের দূষণ প্রতিরোধ, মশা ও বিষাক্ত পোকামাকড় নিধন, রোগ ছড়াতে না দেওয়া, নির্দিষ্ট স্থানে ময়লা ফেলা, গাছ না কাটা, গাছ লাগানো, ইঁদুর নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদির সবই পরিবেশগত স্বাস্থ্যবিধির মাঝে পড়ে। 

আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যও পরিবেশের উপরে নির্ভর করে। এই কারণে কেও হতাশায় ভুগলে তাকে হাওয়া বদলের কথা বলা হয়। আমাদের আশেপাশের পরিবেশ যদি থাকার উপযোগী না হয়, ঘিঞ্জি হয় তবে সেখানে থাকার সময় আমাদের মনেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া রাখবে।

কিছু কাজ যা Environmental Hygiene এর ভিতরে রয়েছে: 

  • যেখানে সেখানে ময়লা না ফেলা। 
  • গাছ না কাটা। 
  • কোনো পানির উৎসে ময়লা, কফ থুথু না ফেলা। 
  • নদী বা খালে শৌচাগার ও কল-কারখানার বজ্রের সংযোগ না দেওয়া। 
  • কলকারখানার চিমনিতে রাসায়নিক ছাকনি ব্যবহার করা। 

Environmental Hygiene মেনে না চললে সমষ্টিগতভাবে আমরা অসুস্থ হয়ে যেতে পার, আমাদের জীবন-ধারনের জন্য আশেপাশের পরিবেশ অনুপযোগী হয়ে পড়তে পারে। 

3. পারিবারিক/সমষ্টিগত স্বাস্থ্যবিধি বা Domestic/Community Hygiene:

একটি মানুষ পরিবারে বাস করে, আর অনেকগুলো পরিবার সমষ্টিগতভাবে একটি সমাজ গড়ে তোলে। আমরা যে বাসায় থাকি তার পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, তাতে উপযুক্ত আলো বাতাস আসছে কিনা তা নিশ্চিত করা, খাবার তৈরির সময় সাবধানতা অবলম্বন করা হচ্ছে কিনা ইত্যাদি পারিবারিক স্বাস্থ্যবিধির ভিতরে পড়ে। আমার সামাজিক প্রাণী হিসেবে আমাদের কিছু সামাজিক স্বাস্থ্যবিধি রয়েছে। এগুলোর অনেকগুলোই পরিবেশগত স্বাস্থ্যবিধির সাথে মিলে গেলেও কিছু আছে যা আলাদা। যেমন: চিকিৎসা সংক্রান্ত স্বাস্থ্যবিধি।

চিকিৎসা সংক্রান্ত স্বাস্থ্যবিধি অনেক ক্ষেত্রেই ব্যক্তিগত কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক হাইজিনের ভিতরে পড়ে কিন্তু এর দ্বারা প্রভাবিত হয় আমাদের আশে পাশের মানুষ। যেমন: একজন চিকিৎসক যদি একজন রোগীকে দেখার আগে তার সরঞ্জামাদি পরিষ্কার না করে তবে সেই রোগী হসপিটাল একুইয়ার্ড ডিজিস (Nosocomial Infection) বা হাসপাতাল থেকে সংক্রামিত ইনফেকশনে আক্রান্ত হয়ে যেতে পারে। তাই এটা চিকিৎসা সেবা যে দিচ্ছে তার দায়িত্ব এই হাইজিন মেনে চলা। একই ভাবে, স্যানিটেশন কর্মী যদি পাবলিক টয়লেট পরিষ্কার করে না রাখে তবে এথেকে সমাজে রোগ ছড়াতে পারে। যেহেতু একজনের জন্য আরেকজন প্রভাবিত হওয়ার একটি ব্যাপার এখানে থাকছে সেহেতু পুরো ব্যাপারটিই সামাজিক স্বাস্থ্যবিধির আওতাভুক্ত।

এই একই বিষয় আমরা খাদ্যাভ্যাসের দিক থেকেও দেখতে পারি। বেশ অনেক এলাকা পাওয়া যায়, যেসকল স্থানে ওবিসিটির হার অন্যান্য জায়গা থেকে বেশি। যেমন: ওশেনিয়া মহাদেশের নাউরু নামের দেশে প্রায় ৩১ শতাংশ মানুষ স্থূলতা সমস্যায় ভুগে। এই ডায়েটের সমস্যা Community Hygiene এর ভিতরে পড়েছে, আবার সোমালিয়ার শিশুদের মাঝে ৪৬.৫%ই অপুষ্টিতে আক্রান্ত। অর্থাৎ সারাদেশে পুষ্টি সংক্রান্ত হাইজিনের এতটাই অভাব যে এত বেশি পরিমাণের শিশু অপুষ্ট রয়ে গিয়েছে। 

4. খাদ্য সংক্রান্ত স্বাস্থ্যবিধি বা Food Hygiene: 

খাবার সংক্রান্ত এক ধরণের হাইজিন তো আমরা সবাই জানি। পরিষ্কার পরিবেশে রান্না করা, হাত ধুয়ে নেওয়া, আসবাবপত্র ও সরঞ্জামাদি পরিষ্কার রাখা, চুল ঢেকে রাখা ইত্যাদির সবই এই খাদ্য সংক্রান্ত হাইজিনের ভিতরে পড়লেও এর ব্যাপকতা আরোও অনেক বেশি। প্রতিনিয়ত খাবারের উৎপাদন বৃদ্ধি করার জন্য জৈব রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করা হইয়। যা আমাদের খাবারের সাথে মিশে অনেক জটিল সমস্যার জন্ম দিতে পারে। এই সকল রাসায়নিক দ্রব্য থেকে খাবারকে রক্ষা করাও ফুড হাইজিনের ভিতরেই পরে। 

আমরা বাজার থেকে যেসকল খাবার কিনে থাকি তার অনেকগুলোই প্লাস্টিক কন্টেইনারে পাওয়া যায়। আমাদের অজান্তেই এই সকল প্লাস্টিক থেকে ক্ষতিকর ক্যামিকেল আমাদের খাবারে চলে আসে যা Food Hygiene এ ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। 

Food Hygiene নিশ্চিতকরণে যে জিনিসগুলো খেয়াল রাখতে হবে

  • হাত, কাপড়, আসবাবপত্র ও খাবারের উপাদানের পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করতে হবে।
  • রাসায়নিক দ্রব্যের সংস্পর্শ থেকে খাবারকে দূরে রাখা। 
  • প্লাস্টিক কন্টেইনার ব্যবহার করলে সেই প্লাস্টিকের গ্রেড কত না নিশ্চিত হয়ে নেওয়া। 
  • বিশুদ্ধ পানি ব্যবহার করা। 

হাইজিন এবং স্যানিটেশনের মাঝে পার্থক্য (Hygiene vs Satiation): 

হাইজিন কি তা আমরা উপরের আলোচনা থেকে অনেকটাই নিশ্চিত। তাহলে এবার দেখা যাক স্যানিটেশন কি? যেহেতু আমরা হাইজিনের ক্ষেত্রে WHO এর সংজ্ঞাকে বেছে নিয়ে ছিলাম সেহেতু এখানেও আমরা একই কাজই করছি। 

স্যানিটেশন কি?:

WHO এর ভাষ্যমতে, "স্যানিটেশন শব্দটির দ্বারা সাধারণভাবে আমরা বুঝি মানুষের পয়ঃবর্জ্য নিষ্কাশনের জন্য উপযুক্ত পদ্ধতি ও এর নিমিত্তে যেসকল পরিসেবা গ্রহণ করা হয়। একই সাথে স্যানিটেশন হলো সুস্থতা বজায়ের জন্য বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও পানি পরিশোধনের মাধ্যমে হাইজিন নিশ্চিত করা। স্যানিটারি ল্যাট্রিন এর ব্যবস্থা করা, সাবানে হাত ধুতে সবাইকে উৎসাহিত করা। "

এর অর্থ হাইজিন আমাদের সুস্থ থাকার সাথে সম্পর্কিত সকল বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত এবং স্যানিটেশন হলো আমাদের আশেপাশের পরিষ্কারের সাথে সম্পর্কিত যেন আমরা হাইজিন মেনে চলতে পারি। 

হাইজিন অনেকক্ষেত্রেই নিজের সচেতনতার সাথে নির্ভর করে আর স্যানিটেশনে সতর্কতা প্রয়োজন কিন্তু কোথাও স্যানিটেশনে সমস্যা হলে আমাদের আশেপাশের সবাই কমবেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে। 

একটা ব্যাপার আলাদা করে বলে রাখা দরকার, আমাদের গৃহের নানা বর্জ্যপদার্থ নিষ্কাসনের জন্য নালা না ড্রেন আছে। আমরা প্রতিদিন নানা রকমের পলিথিন, প্লাস্টিক, ময়লা, সোলার টুকরো ইত্যাদি এই ড্রেনগুলোতে ফেলে থাকি, যার ফলে এই নালা-নর্দমা আটকে যায়, রাস্তায় ড্রেনের পানি চলে আসে, অল্প বৃষ্টিতে রাস্তায় পানি উঠে আর এই পানি পাড়ানোর ফলে নানা রকমের অসুখ ছড়ায়। আমাদের মাথায় রাখতে হবে আস্তাকুড় হলো ময়লা আবর্জনা ফেলার জায়গা আর নর্দমা হলো তরল ও পয়ঃবর্জ্য নিষ্কাশনের জন্য। আমরা এ ব্যাপারে নজর না দিলে বিঘ্ন ঘটবে আমাদের হাইজিন ও স্যানিটেশন। 

পরিশেষে, হাইজিন আমাদের সুস্থ থাকার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হাইজিন নিশ্চিত করতে বিভিন্ন ননপ্রফিট অর্গানাইজেশন এবং বিভিন্ন NGO কাজ করে যাচ্ছে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে। রেডিও ও টেলিভিশনে আগ্রহ জাগানিয়া নানা অনুষ্ঠান সম্প্রচার করতে হবে যেন মানুষ সচেতন হতে পারে। দিন থেকে সচেতনতাই আমাদের হাইজিন ধরে রাখতে সাহায্য করবে।