লিভার (Liver) বা যকৃত কি?  লিভার এর কাজ এবং এটিকে সুস্থ রাখার উপায়

লিভার (Liver) বা যকৃত কি?

Liver কিংবা যকৃত আমাদের শরীরের একটি অভ্যন্তরীণ অঙ্গ যার রঙ লালচে খয়েরি। এটি প্রায় সকল মেরুদণ্ডী প্রাণীর শরীরেই দেখতে পাওয়া যায়। প্রচলিত বাংলায় একে আমরা কলিজা নামেও ডেকে থাকি। এটি আমাদের শরীরের সবচেয়ে বড় গ্রন্থি। নানা রকমের হরমোন তৈরি, এনজাইম তৈরি সহ মেটাবলিজম সংক্রান্ত নানা কাজে এর তুলনা নেই। এটি আমাদের শরীরের একমাত্র অঙ্গ যা নিজে নিজের সম্পূর্ণ ক্ষয়রোধ করে অংশ বিশেষ থেকে সম্পূর্ণ অঙ্গে পরিণত হতে পারে।

আমাদের শরীরে বক্ষপিঞ্জরের নিচের দিকে মধ্যচ্ছদা কিংবা ডায়াফ্রাম অবস্থিত। এই ডায়াফ্রামের নিচে, পাকস্থলীর ডানদিকে আমাদের যকৃত অবস্থিত। আমরা যখন গভীরভাবে শ্বাস নেই তখন আমাদের বক্ষপিঞ্জরের ডান দিকের শেষপ্রান্তে আমরা যে অঙ্গটিকে অনুভব করি সেটিই হলো Liver।

লিভার এর কাজ

যকৃত নানা রকমের কাজ করে থাকে। এর কাজের পরিধি এতটাই বিশাল যে একে মস্তিষ্কের পর পরই শরীরের জটিলতম অঙ্গও বলা হয়। ধারণা করা হয় এটি আমাদের শরীরে পাঁচ শতাধিক কাজ করে থাকে।

নিচে এর গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজের বর্ণনা দেওয়া হলো:

পিত্তরস তৈরি:

পিত্তথলী বা গলব্লাডারের মতো Liver ও পিত্তরস তৈরি করে থাকে। এই পিত্তরসে দূষিত পদার্থ নিষ্কাশনে সাহায্য করে থাকে। একই সাথে এটি ক্ষুদ্রান্তে স্নেহ জাতীয় খাবারের পরিপাকেও সাহায্য করে থাকে।

প্লাজমা প্রোটিন তৈরি:

রক্তের উপাদানগুলোর ভিতরে অন্যতম হলো প্লাজমা। এটিতে আবার প্রয়োজনীয় প্লাজমা প্রোটিন রয়েছে। যকৃত এই প্লাজমা প্রোটিন তৈরি করে থাকে।

কোলেস্টেরল তৈরি:

কোলেস্টেরল আমাদের সারা শরীরে চর্বি পরিবহন এবং আমাদের কোষঝিল্লির গঠনে সাহায্য করে। এই অঙ্গ কোলেস্টেরল তৈরিতে সাহায্য করে।

[বিঃ দ্রঃ কোলেস্টেরল মানেই খারাপ না। শরীরের কাজ সঠিকভাবে করতে নির্দিষ্ট পরিমাণে কোলেস্টেরল থাকা অত্যাবশ্যকীয়। ]

গ্লুকোজ এর পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ:

যকৃত অতিরিক্ত গ্লুকোজ গ্লাইকোজেন হিসেবে সংরক্ষণ করে এবং প্রয়োজনের সময় গ্লাইকোজেন ভেঙ্গে তা গ্লুকোজে পরিবর্তিত করে। 

এমাইনো এসিড তৈরি:

প্রোটিন হলো নানা রকমের এমাইনো এসিড দিয়ে তৈরি দীর্ঘ চেইন। Liver এমাইনো এসিড সংশ্লেষণে সাহায্য করে। 

হরমোন ও এনজাইম তৈরি:

আমাদের নানা রকম শরীরবৃত্তীয় কাজের জন্য প্রয়োজনীয় হরমোন এবং এনজাইম তৈরির কারিগর হলো যকৃত। 

বিলিরুবিন নিয়ন্ত্রণ:

যকৃত বিলিরুবিন নিয়ন্ত্রণ করে। বিলিরুবিন বেড়ে যাওয়াকে জন্ডিসের লক্ষণ হিসেবে ধরা হয়।

দূষিত পদার্থ নিষ্কাশন:

আমাদের শরীরে নানা রকমের দূষিত পদার্থ প্রতিনিয়ত তৈরি হয়। এছাড়া কাজ শেষ হলে ড্রাগস কিংবা মেডিকেশন আমাদের শরীর থেকে বের করে দেওয়ার প্রয়োজন হয়। যকৃত এগুলো নিষ্কাশনের কাজ করে থাকে। 

লিভারের কিছু সমস্যা: 

এর সমস্যা একাই বিশাল আলোচনার দাবি রাখে। এ ধরণের সমস্যার মাঝে রয়েছেঃ

  • হেপাটাইটিস-এ
  • হেপাটাইটিস-বি
  • হেপাটাইটিস-সি
  • লিভার সিরোসিস
  • লিভার ক্যান্সার ইত্যাদি

লিভারে সমস্যার লক্ষণ:

অনেক ক্ষেত্রেই যকৃতে সমস্যা বেশ অনেকটা সময় যাওয়ার পর প্রকাশ পায়। আবার অনেকক্ষেত্রে দেখা যায় শুরুতেই এ সম্পর্কে বুঝা যায়। এমন কিছু লক্ষণ নিচে দেওয়া হলোঃ

  • ত্বক ও চোখের সাদা অংশ হলুদ হয়ে যাওয়া
  • তলপেটে ব্যথা ও ফুলে যাওয়া
  • পা ও গোড়ালি ফুলে যাওয়া
  • প্রস্রাব হলুদ হয়ে যাওয়া
  • চুলকানি
  • পায়খানার বর্ণ ফ্যাঁকাসে হয়ে যাওয়া
  • বমি বমি ভাব
  • শারীরিক অবসাদ থেকে যাওয়া
  • খাওয়ার রুচি চলে যাওয়া

জীবনযাপন এবং লিভার

যকৃত মানবদেহের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যা সামগ্রিক স্বাস্থ্য বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি রক্ত ​​​​প্রবাহ থেকে বিষাক্ত পদার্থগুলিকে নিষ্কাশন করতে, পিত্ত উৎপাদন করতে এবং নানা রকমের ভিটামিন এবং মিনারেলের সঞ্চয় করতে সহায়তা করে। দুর্ভাগ্যবশত, নানা রকমের কাজে নিয়োজিত থাকার কারণে অস্বাস্থ্যকর জীবনধারা পছন্দ দ্বারা Liver সহজেই ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

প্রক্রিয়াজাত খাবার, চিনি এবং অস্বাস্থ্যকর চর্বিযুক্ত খাবার অধিক পরিমাণে খেলে এর সমস্যা দেখা দিতে পারে। যেমন ফ্যাটি লিভার ডিজিজ, লিভারের প্রদাহ এবং লিভার সিরোসিস ইত্যাদি। এছাড়াও, অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবন এর ক্ষতি করতে পারে। যা পরবর্তীতে লিভার সিরোসিসে রূপ নিতে পারে।

শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা এবং শারীরিক পরিশ্রম ছাড়া জীবন-ব্যবস্থা যকৃতের সমস্যায় অবদান রাখতে পারে, কারণ অতিরিক্ত ওজন এবং স্থূলতার কারণে যকৃতে চর্বি জমে যেতে পারে। এছাড়াও, এটি শরীর থেকে ওষুধ এবং অন্যান্য টক্সিন প্রক্রিয়াকরণ এবং নির্মূল করার জন্যও দায়ী, তাই নানা রকমের মেডিসিন, ড্রাগস, রাসায়নিক পদার্থযুক্ত খাবারের অপব্যবহারও এর উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে এবং ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

যেসব খাবার লিভারকে সুস্থ রাখে

নানা রকমের খাবার আছে যা আমাদের লিভারকে নানাপ্রকারে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে থাকে। নিচে সংক্ষেপে এদের সম্পর্কে বলা হলো:

  • এন্টি অক্সিডেন্টযুক্ত খাবার - এন্টি অক্সিডেন্ট ফ্রি রেডিক্যালকে নিষ্ক্রিয় করে লিভারকে সুস্থ রাখে। যেমন: সজনে ডাটা, ডিম, দুধ, কলিজা, বাদাম, গ্রিন টি।
  • মশলা জাতীয় খাবার - রসুন, হলুদ ইত্যাদি যকৃত থেকে টক্সিনকে দূর করে।
  • রঙ্গিন ফল ও শাক সবজি - টমেটো, গাজর, বাধাকপি, লেবু, জাম্বুরা ইত্যাদি
  • হোল গ্রেইন- গম, বার্লি ইত্যাদি।
  • ভালো ফ্যাট সমৃদ্ধ খাবার - আখরোট, অলিভ, এভোকাডো ইত্যাদি।

লিভারকে সুস্থ রাখার উপায়

আমাদের প্রতিদিনের জীবনে আমাদের নানা রকম অভ্যাস আমাদের শরীরের উপরে প্রভাব ফেলে। আমাদের লিভার এর ব্যতিক্রম না। তাই আমাদের জানতে হবে কীভাবে আমরা যকৃতকে সুস্থ রাখতে পারি। নিচে এই সম্পর্কে দেওয়া হলো:

১. অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা না করা:

দুশ্চিন্তা আমাদের মেটাবোলিজমের উপরে প্রভাব ফেলে। এই সময় খাবার গ্রহণ করলে হজমজনিত সমস্যা দেখা দিতে পারে যা আমাদের লিভারের উপরে চাপ তৈরি করে।

২. খাদ্যাভাসে পরিবর্তন:

খাদ্যাভাসে পরিবর্তন ছাড়া লিভারকে সুস্থ রাখা সম্ভব না। ফ্যাট জাতীয় খাবার, অতিরিক্ত চিনি জাতীয় খাবার পরিহার করে আমরা লিভারের উপর থেকে চাপ কমাতে পারি। এছাড়া আমরা হেলদি ফ্যাট আছে এমন খাবার গ্রহণ করতে পারি। প্রয়োজনমাফিক পানি গ্রহণ লিভারের জন্য উপকারী। এছাড়া এলকোহল, ধুমপানকে না করতে হবে। বেশি বেশি উদ্ভিদজাত খাবার খেতে হবে।

৩. ভেষজ উপশম:

নানা রকমের ভেষজ উপাদান আছে যা আমাদের যকৃত থেকে নানা রকমের টক্সিন দূর করে। যেমন: ডেনডোলিয়ন, হলুদ ইত্যাদি।

৪. অতিরিক্ত ঔষধ গ্রহণ:

আমাদের মাঝে এমন অনেক মানুষ আছেন যাদের অপ্রয়োজনে ঔষধ গ্রহণের বাতিক রয়েছে। ঔষধে বিদ্যমান নানা রকম পদার্থ আমাদের লিভারের মাধ্যমে নিষ্কাশিত হয় যা যকৃতের উপরে চাপের সৃষ্টি করে।

৫. চা- কফি পান:

গ্রীন টি, আদা চা, লেবু চা, পরিমিত পরিমাণে কফি আমাদের যকৃতকে সুস্থ রাখে।

৬. টক্সিন থেকে দূরে থাকা:

আমরা প্রতিদিন জেনে না জেনে নানা রকমের টক্সিন ও ক্যামিকেল আমাদের শরীরে প্রবেশ করাই। নানা রকমের প্রসাধনীও ত্বকের মাধ্যমে আমাদের শরীরে শোষিত হয়। এগুলো আমাদের এই প্রয়োজনীয় অঙ্গটির উপরে চাপ তৈরি করে। কৃত্রিম যে কোনো কিছু ব্যবহারের সময় আমাদের সতর্ক হওয়া উচিৎ এবং এই সকল পণ্যের ব্যবহার যতটুকু সম্ভব কমিয়ে দেওয়া প্রয়োজন।

সামগ্রিক স্বাস্থ্য বজায় রাখতে Liver অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং একটি স্বাস্থ্যকর জীবনধারা এর স্বাস্থ্যকেও নিশ্চিত করতে পারে এবং ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করতে পারে। সুষম খাদ্য খাওয়া, নিয়মিত ব্যায়াম করা এবং ক্ষতিকারক পদার্থ এড়ানো সহ নানা রকমের স্বাস্থ্যকর পরিবর্তন পছন্দ করার মাধ্যমে আমরা আমাদের একে রক্ষা করতে এবং দীর্ঘমেয়াদে এর স্বাস্থ্য বজায় রাখতে সাহায্য করতে পারি।