মানবদেহে বিভিন্ন রকমের গ্রন্থি রয়েছে। এসব গ্রন্থি শরীরে বিভিন্ন রকমের প্রয়োজনীয় শারীরবৃত্তীয় কাজ করে থাকে। অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি এই সকল গ্রন্থিগুলোর মাঝে খুবই গুরুত্বপুর্ণ। এটি আমাদের শরীরে মেটাবলিজম, রোগ প্রতিরোধসহ বিভিন্ন অতীব জরুরি কাজে সাহায্য করে থাকে।
অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি বা Adrenal Gland কি?
অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি বা Adrenal gland হলো কিডনির উপরে অবস্থিত ত্রিভুজাকার অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি যা অ্যাড্রিনালিন নামক এক ধরণের হরমোন নিঃসরণ করে থাকে। এই অ্যাড্রিনালিন থেকে এর নামকরণ করা হয়েছে অ্যাড্রিনাল গ্লান্ড। এছাড়াও এই গ্লান্ড আরও নানা রকমের হরমোন নিঃসরণ করে।
যেহেতু এগুলো অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি অর্থাৎ এই গ্রন্থি গুলো কোনো নালিকা ছাড়াই সরাসরি রক্তে হরমোন নিঃসরণ করে থাকে। এই গ্রন্থি সুপ্রারেনাল গ্রন্থি (suprarenal gland) নামেও পরিচিত। মানবদেহের দুই কিডনির উপরেই একটি করে Adrenal gland রয়েছে।
অ্যাড্রিনাল গ্রন্থির কাজ
Adrenal gland আমাদের শরীরে নানা রকমের গুরুত্বপুর্ণ কাজ করে থাকে। নিচে কিছু কাজ উল্লেখ করা হলো:
- মেটাবলিজমে সাহায্য করে।
- রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থায় এর অবদান আছে।
- রক্তচাপের উপরে অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হওয়া হরমোনের ভূমিকা রয়েছে।
- স্ট্রেস ও দুশ্চিন্তা বাড়ানো কিংবা কমানো।
- নর-নারীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নির্ধারণে।
- নানা রকমের হরমোন তৈরি এর প্রধান কাজ।
অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হরমোন সমূহ
অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি আমাদের শরীরের সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ গ্রন্থিগুলোর একটি। কারণ এর থেকে নিঃসৃত হরমোনগুলো ছাড়া আমাদের শরীরের টিকে থাকা মুশকিল। নিচে কিছু গুরুত্বপুর্ণ হরমোন নিয়ে আলোচনা করা হলো:
কর্টিসলঃ
কর্টিসলকে বলা হয় স্ট্রেস হরমোন। এটি আমাদের শরীরের প্রোটিন, ফ্যাট ও শর্করা মেটাবোলিজমে, স্ট্রেস প্রকাশ করতে এবং মনোযোগ বাড়াতে সাহায্য করে।
অ্যালডোস্টেরনঃ
এই হরমোন আমাদের শরীরে রক্তচাপ এবং রক্তে সোডিয়াম-পটাসিয়ামের মাত্রা ঠিক রাখতে সাহায্য করে। এছাড়া রক্তের pH নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
DHEA ও এন্ড্রোজেনিক স্টেরয়েড
এরা পুরুষ হরমোন হিসেবে অন্যদের তুলনায় দুর্বল এবং এদের এরা সরাসরি শারীরিক ক্রিয়ায় কোনো অবদান রাখে না। এরা ওভারিতে ইস্ট্রোজেন এবং টেস্টিসে এরা এন্ড্রোজেনে পরিবর্তিত হয়।
এড্রেনালিন ও নর-এড্রেনালিনঃ
এড্রেনালিন এর অপর নাম হচ্ছে এপিনেফ্রিন। ভয়, ক্লান্তির মতো ব্যাপারগুলো সাথে মোকাবেলা করার জন্য উদ্দীপনা, সাহস যোগায় এটি। এজন্য একে সংকটকালীন হরমোনও বলা হয়। হার্ট রেট, ব্লাড সুগার, রক্ত সংবহন ইত্যাদি ব্যাপারগুলোর সাথে এটি সম্পর্কিত। অনেকক্ষেত্রে এটি ওষুধ হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।
নরএড্রেনালিন আরেক নাম নরএপিনেফ্রিন। এটি অনেকটা এপিনেফ্রিন এর মতোই। ফোকাস ও মনোযোগ বাড়াতে এটি ওষুধ হিসেবে অনেককেই নিতে বলা হয়।
এড্রেনালিন গ্রন্থির রোগসমূহ
এড্রেনালিন গ্লান্ডের বিভিন্ন রকমের অসুখ হয়ে থাকে। এই অসুখ সমূহ গ্লান্ডের হরমোন তৈরির পরিমাণ বেড়ে যাওয়া অথবা কমে যাওয়ার কারণে হয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে এই অবস্থা স্বল্প সময়ে তৈরি হয় আবার অনেক সময় এগুলো দীর্ঘদিন ধরে ধীরে ধীরে তৈরি হয়। যেমন:
- Addison Disease (অ্যাডিসন’স ডিজিস): এটি এমন একটি অটো-ইমিউন ডিজিস যার ফলে আমাদের শরীরে এড্রেনালিন গ্লান্ড প্রয়োজনের চেয়ে কম কর্টিসল ও অ্যালডোস্টেরন তৈরি করে।
- Cushing Syndrome (কুশিং সিন্ড্রোম): যখন Adrenal gland অতিরিক্ত কর্টিসল তৈরি করা শুরু করে তখন এই রোগ দেখা দেয়। ফলে বিভিন্ন রোগ যেমন স্থুলতা, দুর্বলতা, যৌন অক্ষমতা ইত্যাদি দেখা দেয়।
- Congenital adrenal hyperplasia (কনজেনিটাল অ্যাড্রিনাল হাইপারপ্লাসিয়া): এই অসুখ জন্মগত। এই অসুখে বাচ্চারা সেই হরমোনটাই তৈরি করতে পারে না যা ব্যবহার করে অ্যাড্রিনাল গ্লান্ড অন্যান্য হরমোন তৈরি করে।
এই গ্লান্ডের রোগের ও লক্ষণ কারণসমূহ:
এই গ্রন্থটি দ্বারা নিঃসৃত হরমোনের পরিমাণ এর উপর গ্রন্থটির বিভিন্ন রোগ সৃষ্টি হওয়া নির্ভর করে থাকে। তাই রোগের লক্ষণেও পার্থক্য দেখা যায়। এখানে কিছু সাধারণ লক্ষণ দেওয়া হলো:
১। মেটাবলিক লক্ষণ: ব্যাখ্যাতীত ওজন বৃদ্ধি বা হ্রাস, অকারণেই রক্তে স্যুগার লেভেল হ্রাস বা বৃদ্ধি, দুর্বলতা।
২। রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থায় লক্ষণ: নিয়মিত অসুস্থতা এবং ইনফেকশন।
৩। রক্ত চাপজনিত লক্ষণ: উচ্চ ও নিম্ন রক্তচাপ।
৪। যৌন আচরণে পরিবর্তন: মেয়েদের মুখে দাড়ি গজানো কিংবা টাক হয়ে যাওয়া, মুখে মেছতা দেখা দেওয়া, গলায় পুরুষালি ভাব চলে আসা ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিতে পারে।
অ্যাড্রিনালের গ্লান্ডের রোগ বিভিন্ন রকম কারণে হতে পারে। নিচে উল্লেখযোগ্য কিছু কারণ দেওয়া হলো:
- জেনেটিক মিউটেশন
- অটোইমিউন ডিজিস
- টিউমার
- অ্যাড্রিনাল গ্লান্ড দুর্ঘটনা, রক্তশুন্যতা কিংবা অসুখজনিত ক্ষত বা আঘাত
- কিছু স্টেরয়েড মেডিকেশনের প্রভাবে
যেসব খাবারে অ্যাড্রিনাল গ্লান্ড সুস্থ থাকে
অ্যাড্রিনাল গ্রন্থিকে সুস্থ রাখতে স্বাস্থ্যকর খাবারের কোনো বিকল্প নেই। কিছু খাবার যা এই গ্লান্ডকে সুস্থ রাখতে পারে তা নিচে দেওয়া হলো:
- পুষ্টিকর আমিষ: মাছ , মুরগীর মাংস।
- ভিটামিন - ই সমৃদ্ধ খাবার: জলপাই, কাঠবাদাম, ব্রকলি।
- আয়োডিন সমৃদ্ধ খাবার: সামুদ্রিক মাছ, খাবার লবণ।
- ম্যাগনেসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার: পালং শাক, শিম।
- Gluten Free Diet: বাদামি চাল, ওটস, ভুট্টা।
- ভিটামিন বি সমৃদ্ধ খাবার: মুরগীর কলিজা, ফুলকপি, মাশরুম।
যেসব খাবার এই গ্লান্ডের জন্য ক্ষতিকর
এমন অনেক খাবার আছে যা সরাসরি Adrenal gland এর ক্ষতি করে থাকে। আবার কিছু রয়েছে যা অতিরিক্ত পরিমাণে গ্রহণ করা ক্ষতিকর। এর মাঝে রয়েছে:
- Gluten - সমৃদ্ধ খাবার অনেক সময় ক্ষতির কারণ হতে পারে- বার্লি, সুজি
- ক্যাফেইন সমৃদ্ধ খাবার - কফি, চা, চকলেট
- সোডা ব্যবহার করা হয় এমন খাবার - নানা রকমের বেকারিজাত খাবার
- প্রসেসড ফুড - পেস্ট্রি, কেক, সসেজ
- এলোহলিক বেভারেজ - বিয়ার, ভদকা
- ফাস্ট ফুড - বার্গার, পিজ্জা ইত্যাদি
প্রশ্ন: অ্যাড্রিনাল হরমোনসমূহ ছাড়া কি আমরা বাঁচতে পারি?
উত্তর: না। এড্রেনাল হরমোন আমাদের শরীরের খুবই গুরুত্বপূর্ণ শরীরবৃত্তীয় কাজ করে থাকে। যা ছাড়া আমাদের টিকে থাকা মুশকিল।