আমরা প্রতিদিন বিভিন্ন রকমের শারীরিক ও মানসিক চাপের ভিতর দিয়ে অতিবাহিত করি। যার বেশির ভাগই আমরা মোকাবেলা করতে সক্ষম হই। চাপ বা স্ট্রেস এর প্রভাব থেকে শরীর ও মনকে সুস্থ রাখতে মানবদেহ এক ধরণের হরমোন ক্ষরণ করে। এই হরমোনের নাম হলো কর্টিসল।
কর্টিসল বা Cortisol কি?
কর্টিসল হলো একধরণের স্টেরয়েড হরমোন যা আমাদের এড্রেনাল গ্লান্ড তৈরি করে। কর্টিসল বিভিন্ন শরীরবৃত্তীয় কাজে সাহায্য করে। তবে এর মূল কাজ স্ট্রেস মোকাবেলা করতে সাহায্য করা। এজন্য cortisol স্ট্রেস হরমোন নামেও সবার কাছে সুপরিচিত।
কর্টিসোল হরমোনের এর ভূমিকা
আমাদের শরীরে কর্টিসলের নানা রকমের অবদান রয়েছে। এর কিছু ভালো আবার কিছু মন্দ। এদের মাঝে উল্লেখযোগ্য কিছু অবদান নিচে দেওয়া হলো:
১. স্ট্রেস মোকাবেলা করতে:
এই হরমোন স্ট্রেস মোকাবেলা করতে সাহায্য করে । স্ট্রেসের সময় শরীরের এড্রেনালিন ক্ষরণের পর আমাদের শরীর cortisol ক্ষরিত হয় যেন আমরা সদা সতর্ক থাকতে পারি। একই সাথে এই হরমোন লিভার থেকে Glucose ছাড়তে সহায়তা করে। এতে করে চাপের মুহূর্তে আমরা প্রয়োজনীয় শক্তি পাই।
২. মেটাবোলিজম বৃদ্ধিতে:
আমাদের শরীরের মেটাবলিজম প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই ক্ষেত্রে শর্করা ,আমিষ ও স্নেহ জাতীয় খাদ্যের পরিপাক ক্রিয়াতে এর অবদান রয়েছে।
৩. রক্তচাপের উপরে ভূমিকা:
রক্তচাপের উপরে এর প্রভাব আছে। কর্টিসলের কীভাবে আমাদের রক্তচাপের সাথে যোগসাজশ আছে তার সঠিক কারণ এখনো জানা যায় নি। তবে এর লেভেল বেড়ে গেলে আমাদের রক্ত চাপও বেড়ে যায় আর এর পরিমাণ কমে আসলে রক্তচাপও কমে আসে।
৪. সুগার লেভেলের উপরে প্রভাব:
রক্তের সুগার লেভেলের উপরে এর প্রভাব রয়েছে। কর্টসলে অনেকক্ষেত্রেই ইনসুলিনের বিপরীত কাজ করে থাকে। এটি লিভার থেকে Glucose রক্তে প্রবেশ করায় এবং জরুরী শক্তির যোগান দেয় তবে এই প্রক্রিয়া অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়লে তা ইনসুলিন রেসিসিটেন্স ও ডায়াবেটিস এর দিকে নিয়ে যেতে পারে।
৫. ঘুম ও জাগরনে:
আমাদের ঘুমানো ও জেগে উঠার চক্রের উপরে এর প্রভাব রয়েছে। প্রাতঃকালে cortisol লেভেল অনেক কমে আসে তখন আমাদের শরীরে ঘুমের প্রয়োজন হয় আবার প্রত্যুষে যখন আমরা জেগে উঠি তখন এর পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়। তাই ধারনা করা হয় আমাদের ঘুম ও জেগের ওঠার পেছনে এর অবদান আছে।
৬. ইনফ্লেমেশন কমাতে:
আমাদের শরীরে cortisol ইনফ্লেমেশন কমিয়ে রাখতে কাজ করে। তবে আমাদের শরীরে যদি সব সময়ই উচ্চহারে cortisol থাকে তাহলে বিপরীত ফলাফলও আসতে পারে। আর তাহলো নতুন করে ইনফ্লেমেশন তৈরি ও দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা।
৭. যৌন জীবনে প্রভাব:
এই হরমোন টেস্টোস্টেরনের পরিমান কমিয়ে দেয়।
আমাদের শরীর cortisol এর লেভেলকে সব সময় পর্যবেক্ষণে রাখে, এর পরিমাণ স্বাভাবিক থেকে বেড়ে গেলে কিংবা কমে গেলে আমাদের শরীরের ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।
Cortisol লেভেল বেড়ে যাওয়ার কারণ ও লক্ষণ
নিম্নোক্ত কারণে এর পরিমান বেড়ে যেতে পারে:
- কর্টিকো-স্টেরয়েড মেডিসিন সেবনে এই হরমোনের লেভেল বেড়ে যেতে পারে।
- কিছু কিছু ধরণের টিউমারের কারণে কর্টিসল এর মাত্রা বেড়ে যায়।
- এড্রেনালিন টিস্যুর সংখ্যা বেড়ে গেলে এই হরমোনের ক্ষরণকারী কোষের সংখ্যা বেড়ে যায়। এতে করে এটির উৎপাদনও বেড়ে যায়।
কর্টিসলের মাত্রা বেড়ে গেলে আমাদের শরীর কিছু নির্দেশিকা দেয়। এর ভিতরে রয়েছে:
- চেহারা ও তলপেটে চর্বি জমা
- দুই হাতের নিচের দিকে চর্বি জমা
- তলপেটে প্রশস্ত, বেগুনী বর্ণের স্ট্রেচ মার্ক
- পেশীতে জোড় কমে যাওয়া
- ব্লাড সুগার এবং এ থেকে টাইপ-২ ডায়াবেটিস
- উচ্চ রক্তচাপ
- হাড্ডির ভঙ্গুরতা বেড়ে যাওয়া।
যেসব খাবার কর্টিসলের মাত্রা বাড়ায়:
এমন কিছু খাবার আছে যা অপ্রয়োজনীয় হারে কর্টিসলের মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে।
যেমন:
- প্রক্রিয়াজাতকৃত মাংস
- ক্যাফেইন
- এলকোহল
- মাত্রাতিরিক্ত চিনি সমৃদ্ধ খাবার
Cortisol লেভেল কমে যাওয়ার কারণ ও লক্ষণ
এই হরমোনের মাত্রা কমে যাওয়ার দুটি কারণ হলো :
১. প্রাইমারি এড্রেনাল ইনসাফিসিয়েন্সি: এই ক্ষেত্রে আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতায় নিয়োজিত কোষগুলো আমাদের এড্রেনাল গ্লান্ডকে আক্রমণ করে আর এতে সক্রিয় কোষের পরিমাণ কমতে থাকে। যার ফলে কর্টিসলের মাত্রাও কমে যায়।
২. সেকেন্ডারি এড্রেনাল ইনসাফিসিয়েন্সি: কিছু কিছু টিউমারের কারণে Cortisol তৈরি হতে পারে না। ফলে এর মাত্রা কমে যায়।
এই হরমোনের মাত্রা কমে গেলে নিম্নের লক্ষণ গুলো দেখা দিতে পারে:
- দুর্বলতা
- অনিচ্ছাকৃত ওজন হ্রাস
- অরুচি
- নিন্ম রক্তচাপ
যেসব খাবার কর্টিসলের মাত্রা কমায়:
এমন কিছু খাবার আছে যেগুলো এই স্ট্রেস হরমোনের মাত্রাকে কমাতে সাহায্য করে। এই সকল খাবারের মাঝে রয়েছে:
- গ্রিন টি
- নিউট্রিশনাল ইস্ট
- চর্বিযুক্ত মাছ
- সুর্যমুখীর বীজ
- মিষ্টি আলু ইত্যাদি
কর্টিসল হরমোনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের উপায়
আমাদের শারীরিক প্রয়োজনে অনেক ক্ষেত্রে কর্টিসলের মাত্রা কমানোর প্রয়োজন পড়তে পারে। এই উপায় গুলোর মাঝে রয়েছে:
১. নির্দিষ্ট সময়ে ঘুম:
নিয়ম মাফিক ঘুম আমাদের এই হরমোনের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে।
২. নিয়মিত ব্যায়াম:
অনেক গবেষণাতে দেখা গিয়েছে নিয়মিত ব্যায়াম ভালো ঘুমাতে সাহায্য করে এবং স্ট্রেস কমায়। এর ফলশ্রুতিতে এই হরমোনের মাত্রাও কমে আসে ।
৩. চাপ ও দুশ্চিন্তা কমানো:
নিজের চিন্তার ধরণ, গভীরতা, সে সময়ে হৃৎস্পন্দনের মাত্রা ইত্যাদি সম্পর্কে ধারনা থাকলে তা এই হরমোনের মাত্রাকে কমাতে সাহায্য করবে।
৪. প্রাণ খুলে হাসা:
হাসলে মন ভালো থাকে, হার্ট ভালো থাকে। এতে কমে চাপ, আর সাথে সাথে কমে যায় cortisol.
৫. সবার সাথে সুসম্পর্ক বজায়ে রাখা:
আমরা সামাজিক জীব। সমাজে থেকেই আমাদের অভ্যাস। তাই সমাজের সবার সাথে আমাদের স্বাস্থ্যকর সুসম্পর্ক বজায় রাখা উচিৎ। এতে আমাদের স্ট্রেস কমে আসে। তাই এই হরমোন ও কমে যায়।
আমরা সুস্থ ,স্বাভাবিক, চাপহীন জীবন যাপনের চেষ্টা করবো। এতে আশা রাখা যায় আমাদের cortisol সমন্ধনীয় সমস্যাগুলো অনেকটা কমে যাবে। তবে কারো যদি কোনো অসুস্থতা অনুভূত হয় তবে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিৎ।