কার্নিভর ডায়েট বা Carnivore Diet কি?
কার্নিভর ডায়েট বা Carnivore Diet হলো এমন একটি নিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস যার মূল লক্ষ্য শুধুমাত্র প্রাণীজ খাবার গ্রহণ করা এবং কোনও প্রকারের শর্করা জাতীয় খাদ্য গ্রহণ না করা। এই ধরনের ডায়েটে মাখন, পনিরের ব্যতীত ল্যাকটোজ সমৃদ্ধ দুগ্ধজাত খাবার গ্রহণকেও নিরুৎসাহিত করা হয়।
মূলত মানব জাতির প্রাক্কালে মানুষ মাংস জাতীয় খাবার খেয়েই বেচে থাকতো, টিকে ছিল এবং শর্করা জাতীয় খাদ্যই আমাদের শারীরিক সকল সমস্যার মূল, এই ধরনের একটি বিতর্কিত ধারণা থেকে এই ডায়েটের প্রচলন হয়।
এমনটা দাবি করা হয় যে, এই ডায়েট প্ল্যান এর অনুসারীগণ নানা রকমের সমস্যা থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পেরেছেন, যার ভিতরে আছে হতাশা, অবসাদ, দুশ্চিন্তা, ডায়েবেটিকস (diabetics) এবং আর্থাইটিস (arthritis). তবে এই ব্যাপারে কোনও নিয়ন্ত্রিত পরিসংখ্যান এবং গবেষণা করা সম্ভব হয়নি, তাই এই দাবির সত্যতা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।
কার্নিভর ডায়েটে খাবার তালিকা
এই নিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাসে যে কোনও রকমের মাংস, ডিম, মাছ কিংবা এই জাতীয় প্রক্রিয়াজাতকৃত খাবার খাওয়া যাবে। আবার এই ডায়েটে অধিক ফ্যাট সমৃদ্ধ মাংসের টুকরো খাওয়ার ক্ষেত্রে অনেকটা উৎসাহিত করা হয় যেন দৈনিক প্রয়োজনীয় শক্তির কোনও অভাব না হয়। এক্ষেত্রে ক্যালোরি গ্রহণ কিংবা নিয়ন্ত্রণ, খাবার গ্রহণের পরিমাণের উপরে খুব বেশি বাধ্যবাধকতা দেওয়া হয় না। প্রায়শইঃ এর অনুসারীদেরকে পেট ভরতে যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু খাবার গ্রহণ করতে বলা হয়। এই ক্ষেত্রে একটি ছোট তালিকা করা যাক:
১. মাংস: গরু, মুরগী, ছাগল ইত্যাদি
২. মাছ: সামুদ্রিক ও নদীর মাছ - রুই, কাতলা, ইলিশ, স্যালমন
৩. জলজ প্রাণি: চিংড়ি, কাকড়া, লবস্টার
৪. প্রসেসড খাবার: সসেজ, প্যাপারনি, শুটকি
৫. ডিম: মুরগীর ডিম, হাসের ডিম, মাছের ডিম
৬. স্নেহ জাতীয় খাদ্য: নানা রকম প্রাণিজ চর্বি, রান্নার করার জন্য তেল
৭. দুধ জাতীয় খাদ্য: ঘি, মাখন, পনির।
কার্নিভর ডায়েটে যে ধরণের খাবার গ্রহণ করা যাবে না
এই ডায়েটে প্রথমেই যা করতে হবে তা হলো, উদ্ভিজ্জ যে কোনও প্রকারের খাবার বাদ দিতে হবে তা যে ধরনেরই হোক না কেনও। এর মানে শাক সবজি, ফল-মূল কোনও কিছুই খাওয়া যাবে না । এমন কি দুগ্ধজাত খাবার যাতে ল্যাকটোজ এর পরিমাণ বেশি সেগুলোকেও যতটা সম্ভব বাদ দিতে হবে।
কার্নিভর ডায়েটের ভালো দিক
কার্নিভর ডায়েটের কিছু ভালো দিক রয়েছে। নিচে আলোচনা করা হলো:
- বেশি পরিমাণে আমিষ জাতীয় খাবার আর স্বল্প পরিমাণে শর্করা গ্রহণ ওজন কমাতে সাহায্য করে। এই তত্ত্বের উপরে অনেক ডায়েট প্ল্যানই কাজ করে। কার্নিভর ডায়েটও এর ব্যতিক্রম না।
- যত ইচ্ছা খাওয়া যায় বলে পেটে পূর্ণতার অনুভূতি হয় এবং সেই সাথে ক্যালরিও কম গ্রহণ করা হয়। তাই অধিক খাওয়া কিন্তু কম ক্যালরি গ্রহণ করতে চাইলে কার্নিভর ডায়েট একটা সমাধান হতে পারে।
- যেহেতু শর্করা গ্রহণ করা হয় না তাই রক্তে স্যুগার লেভেল মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যেতে দেয় না।
কার্নিভর ডায়েটের খারাপ দিক
এই ডায়েট প্ল্যানে অনেক বিতর্কিত এবং ক্ষতিকর ব্যাপার রয়েছে। এ ব্যাপারে আমাদের জানা জরুরি। নিচে এর কিছু ক্ষতিকর দিক দেওয়া হলো:
উচ্চ পরিমাণে চর্বি, কোলেস্টেরল এবং সোডিয়াম:
কার্নিভর ডায়েটে চর্বি জাতীয় অংশ খাওয়ার ক্ষেত্রে উৎসাহিত করা হয় আর এই চর্বি জাতীয় খাবার কোলেস্টেরল লেভেল বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য দায়ী। যা ফ্যাটি লিভার ও হৃদরোগে রূপ নিতে পারে। সেই সাথে নানা রকমের প্রসেসড খাবার, যেমনঃ সসেজ, ক্যানড ফুড ইত্যাদিতে উচ্চমাত্রায় সোডিয়াম রয়েছে। যা উচ্চ-রক্তচাপের জন্য দায়ী।
ফাইবার এর অভাব:
উদ্ভিজ্জ ফাইবার আমাদের ক্ষুদ্রান্ত্রের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করে, পেট পরিষ্কার রাখে, মল ত্যাগের প্রক্রিয়াকে সচল রাখে। আমাদের অন্ত্রের উপকারী ব্যাকটেরিয়ার জন্যও এই ফাইবার গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে কার্নিভর ডায়েট পুরোপুরিই উদ্ভিজ্জ ফাইবারকে বাদ দিয়ে দেয়। এতে আমাদের অন্ত্রের স্বাস্থ্য খারাপের দিকে যায়, ডায়রিয়া-আমাশয় এর দিকে ধাবিত হতে পারে।
অতিরিক্ত প্রোটিন গ্রহণ:
অতিরিক্ত প্রোটিন গ্রহণে তৈরিকৃত বর্জ্রপদার্থ অন্ত্রে প্রদাহ তৈরি, ক্ষত তৈরিতেও ভূমিকা রাখতে পারে।
ভিটামিন ও মিনারেলস এর অভাব:
ভিটামিন ও মিনারেলস এর এক বিশাল উৎস হলো উদ্ভিদ। প্রাণীজ খাদ্য ঠিক একইভাবে আরও এক ধরণের উৎস। কিন্তু শুধুমাত্র প্রাণীজ খাদ্যগ্রহণ বিশাল ভিটামিন আর মিনারেলস এর আধার থেকে আমাদের দূরে সরিয়ে রাখবে, যা নানা রকমের সমস্যার জন্ম দিতে পারে।
সার্বজনীন নয়:
কার্নিভর ডায়েট এমন একটি ডায়েট যা সবার জন্য আদর্শ না। যেমনঃ কিডনি সমস্যায় আক্রান্ত একজন মানুষের প্রয়োজন প্রোটিন গ্রহণের পরিমাণ কমিয়ে দেওয়া। সেক্ষেত্রে এই ডায়েট প্ল্যান অনুসরণ করা সম্ভব নয়। আবার যাদের হৃদরোগ আছে তাদের জন্যও এই ডায়েট গ্রহণযোগ্য নয়। একই সাথে এই খাদ্যাভ্যাস গর্ভবতী এবং বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন এমন মহিলাদের জন্য অনুপযোগী।
কার্নিভোরাস ডায়েট একটি অত্যধিক নিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস। যদিও এটি নানা রকম স্বাস্থ্যগত উপকারের কথা দাবি করে কিন্ত এর পক্ষে অকাট্য প্রমাণ নেই বললেই চলে। সর্বোপরি এই পন্থার প্রবর্তক শন বেকারের মেডিক্যাল লাইসেন্স, যোগ্যতার প্রশ্নে বাতিল করে দেয় নিউ মেক্সিকো মেডিক্যাল বোর্ড।
কার্নিভর ডায়েট অপ্রয়োজনীয়-ভাবে অতি-নিয়ন্ত্রিত যা কোনোভাবেই ব্যবহারিক না। এর চেয়ে সুষম স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ অনেক উপকারিতা বয়ে আনতে পারে।