-
প্রি-ডায়াবেটিস বা Prediabetes কি?
প্রি-ডায়াবেটিস হলো এমন একটি শারীরিক অবস্থা যখন আমাদের শরীরের রক্তে গ্লুকোজ এর পরিমাণ স্বাভাবিক মাত্রা থেকে বেশি থাকে, কিন্তু সেটা এতটাও বেশি না যে একে ডায়াবেটিস রোগ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত হওয়ার একটি বড় লক্ষণ হলো এই Prediabetes অবস্থা। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রি-ডায়াবেটিস এ আক্রান্ত ব্যক্তিদের পরবর্তী পাঁচ থেকে দশ বছরের মধ্যে ডায়াবেটিস রোগ হওয়ার সম্ভাবনা ৫০% হয়ে থাকে।
পেশাদার চিকিৎসকরা ফ্রি ডায়াবেটিস অবস্থাকে বিভিন্ন নামে উল্লেখ করে থাকে। যেমন:
- Impaired Fasting Glucose (IFG) - যার মানে সকাল বেলা খাওয়ার আগে রক্তে সুগারের পরিমাণ স্বাভাবিক মাত্রা থেকে বেশি থাকে।
- Impaired Glucose Tolarence (IGT) - মানে খাওয়ার পরে রক্তে সুগারের পরিমাণ স্বাভাবিক অবস্থা থেকে বেশি থাকে।
মোটামুটি প্রায় সকল ডায়াবেটিস রোগীরাই Prediabetes এ আগে আক্রান্ত হয়। কিন্তু সমস্যার কথা হলো এর নির্দিষ্ট কোনো লক্ষণ নেই যার মাধ্যমে একজন সতর্ক হতে পারবে যে সে প্রি-ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।
প্রি-ডায়াবেটিসের লক্ষণসমূহ:
প্রি-ডায়াবেটিসের এমন কোনো লক্ষণ নেই যার মাধ্যমে নিশ্চিত করেই আমরা বলতে পারি যে একজন ব্যক্তি এই সমস্যায় আক্রান্ত হয়েছেন।
তবে সাধারণ যে লক্ষণগুলো আমাদের শরীর দিয়ে থাকে তার ভিতরে রয়েছে:
শরীরের বিভিন্ন স্থানের রঙ পরিবর্তন হতে দেখা। যেমন: কালচে ভাব বা ফ্যাকাসে ভাব চলে আসা। এর ভিতরে রয়েছে কনুই, হাঁটু, ঘাড়, বগল ইত্যাদি স্থানের বিবর্ণতা।
আবার কোনো ব্যক্তির শরীরে যদি নিম্নোক্ত লক্ষণগুলো দেখা দেয় তাহলে তার অবশ্যই ডাক্তারের সাথে কথা বলা উচিত এবং Prediabetes পরীক্ষা করা উচিত:
- তৃষ্ণা বেড়ে যাওয়া।
- ঘন ঘন প্রসাব হওয়া।
- ক্লান্তি।
- চোখে ঝাপসা দেখা।
- ঘা শুকাতে সময় নেওয়া ।
এগুলো মূলত ডায়াবেটিস এর লক্ষণ। এগুলো দেখা দিলে আমাদের সতর্ক হয়ে ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
প্রি-ডায়াবেটিস এর কারণ:
বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার মতো প্রি-ডায়াবেটিসেরও নানা রকম কারণ রয়েছে। নিম্নে এ অবস্থার দুটি গুরুত্বপূর্ন কারণ ইনসুলিন রেজিস্টেন্স এবং মেটাবলিক ডিস্টার্বেন্স নিয়ে আলোচনা করা হলো:
ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স:
অগ্ন্যাশয় অগ্ন্যাশয় আমাদের শরীরে ইনসুলিন ক্ষরণ করে যা রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে এবং গ্লুকোজকে রক্ত থেকে আমাদের শরীরের কোষের ভিতরে প্রবেশ করতে সাহায্য করে। যার ফলশ্রুতিতে আমরা শক্তি পেয়ে থাকি। কোষের এই গ্লুকোজ গ্রহণের ক্ষমতা নির্ভর করে ইনসুলিন সেন্সিটিভিটি এর উপরে। ইনসুলিন সেন্সিটিভিটি কমে গেলে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স বেড়ে যায়, যার ফলে শরীর ইনসুলিন হরমোনকে ঠিক মতো ব্যবহার করতে পারে না। এ পরিস্থিতি আমাদেরকে Prediabetes এর দিকে নিয়ে যেতে পারে যা পরবর্তীতে টাইপ-২ ডায়াবেটিসে পরিবর্তিত হয়।
মেটাবলিক ডিস্টার্বেন্স:
আমাদের শরীরে মেটাবলিজমে সমস্যা দেখা দিলে কার্বোহাইড্রেট সহ অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের নিয়ন্ত্রণে ব্যাঘাত ঘটে। যার ফলে রক্তে সুগার লেভেল বেড়ে যায়। একে হাইপারগ্লাইসেমিয়া বলে। এ থেকে ইনসুলিন রেসিসটেন্সও হতে পারে।
এছাড়াও আরো কিছু বিষয় বা নিয়ামক আছে যা প্রি-ডায়াবেটিস এর ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। যেমন:
- বয়স: ৪৫ বছর কিংবা তার বেশি বয়সের মানুষদের Prediabetes এর ঝুঁকি বেশি।
- ওজন: যাদের BMI ২৫ এর বেশি তারা ঝুঁকিতে রয়েছেন।
- কোমরের পরিধি: গবেষণায়দেখা যায়, যাদের কোমরে নিতম্বের তুলনায় বেশি চর্বি রয়েছে তাদের প্রি-ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার হার বেশি।
- জাতিগত কারণ: অনেক সময় অনেকের জাতিগত-ভাবেই ডায়াবেটিস আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। যেমন: আফ্রিকান আমেরিকান, এশিয়ান আমেরিকানদের।
- খাদ্যাভ্যাস: আমাদের খাদ্যাভ্যাসের সাথে এই রোগ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। অধিক কার্বোহাইড্রেট ও ফ্যাট এর ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
- পারিবারিক ইতিহাস: পরিবারের বড় কেও আক্রান্ত হলে ছোটদের কিংবা বংশধরদের আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে।
- ধূমপান: ধূমপান শারীরিক সক্ষমতা কমায়, Prediabetes এর ঝুঁকি বাড়ায়।
- মেডিক্যাল হিস্ট্রি: কোলেস্টেরল বৃদ্ধি, হাই ব্লাড প্রেশার ইত্যাদি সমস্যায় থাকা মানুষদের প্রি-ডায়াবেটিক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
প্রি-ডায়াবেটিস থেকে মুক্তির উপায়:
আমরা চাইলেই কিছু নিয়ম মেনে চলে এই শারীরিক সমস্যা থেকে বাঁচতে পারি। এই সকল নিয়মের মধ্যে রয়েছে:
- নিয়মিত ব্যায়াম করা।
- অতিরিক্ত পরিমাণে না ঘুমিয়ে নিয়মিত একটা সময়ে পরিমিত পরিমাণে ঘুমিয়ে নেওয়া।
- ওজন নিয়ন্ত্রণ করা।
- খাদ্যতালিকায় প্রচুর ফাইবারযুক্ত খাবার রাখা। লো কার্ব ডায়েট মেনে চলা।
- ডাক্তার যদি ঔষধ দেয় তবে তা নিয়ম মাফিক সেবন করা।
প্রি-ডায়াবেটিসের ঝুঁকিসমূহ:
সময়ের সাথে সাথে Prediabetes এ আক্রান্ত ব্যক্তিরা নিচের সমস্যাগুলোর সম্মুখীন হতে পারে:
- টাইপ-২ ডায়াবেটিস
- হার্টের সমস্যা
- স্ট্রোক
- কিডনি রোগ
- চোখের সমস্যা
- ত্বকের সমস্যা
- হ্রসশ্রবণ
- এলজাইমার’স ডিজিস ইত্যাদি
প্রি ডায়েবেটিস এর ব্লাড সুগারের মাত্রা:
নিচের তালিকা থেকে আমরা জানতে পারি আমাদের রক্তে সুগারের পরিমাণ কেমন হতে হবে। আর কেমন হলে তা প্রি ডায়াবেটিস হিসেবে গণ্য হবে।
ব্লাড সুগার মনিটোরিং করতে নিচের চার্টটি ব্যবহার করা যেতে পারে:
প্রি-ডায়াবেটিস রোগের চাইতে সামনে বড় অসুখের সতর্কবার্তাই বলা চলে। এককভাবে এই অসুখ হয়ত আমাদের তেমন কোনো শারীরিক সমস্যা দেয় না কিন্তু যদি আমরা একে অবহেলা করি তবে আমাদের বড় স্বাস্থ্যঝুকির মাধ্যমে এর খেসারত দিতে হতে পারে।