রাত হলে আমাদের ঘুম আসে। সকাল হলে আমরা জেগে উঠি। আমাদের শরীর যেন নিজস্ব ঘড়ি দিয়ে সময় মেপে আমাদেরকে নানা রকমের কাজের কথা জানান দেয়। একটি হরমোন আছে, যা মানবদেহকে এই কাজে সাহায্য করে। মেলাটোনিন হলো সেই হরমোন।
মেলাটোনিন বা Melatonin কি?
মেলাটোনিন হলো এমন একটি হরমোন যা প্রাকৃতিকভাবে মস্তিষ্কের পিনিয়াল গ্লান্ড দ্বারা উৎপাদিত হয় এবং আমাদের ঘুম-জাগরণ চক্রকে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে এবং আমাদের সারকেডিয়ান রিদমকে বজায় রাখতে ভূমিকা পালন করে। মেলাটোনিনের মাত্রা স্বাভাবিকভাবেই সন্ধ্যায় বৃদ্ধি পায় এবং সকালে হ্রাস পায়, যা আমাদের শরীরকে সংকেত দিতে সাহায্য করে যে এটি ঘুমানোর সময়।
যদিও Melatonin নিজে সরাসরি আমাদের ঘুম পাড়িয়ে দেয় না। এটি আমাদের শরীরকে জানান দেয় যে এখন রাত হয়েছে, এখন ঘুমানো প্রয়োজন। একারণে অনেকেই কাছেই Melatonin সাপ্লিমেন্ট ঘুমের ওষুধের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। এছাড়াও এটির এন্টিঅক্সিডেন্ট (Anti Oxidant) ও এন্টি ইনফ্লামেটরি (Anti Inflammatory) প্রভাবও রয়েছে।
মেলাটোনিন হরমোন এর উৎপত্তিস্থল এবং যেভাবে কাজ করে
মেলাটোনিন এমন একটি হরমোন যা আমাদের শরীরে পিনিয়াল গ্লান্ডে তৈরি করে থাকে। এই গ্রন্থির অবস্থান মস্তিষ্কের কেন্দ্রে এপিথ্যালামাসের ভেতরে। তবে এটি অন্যান্য জায়গায়ও পাওয়া যায় যেমন: অস্থিমজ্জা, চোখ, গাট ইত্যাদি।
দেহঘড়ি - এই শব্দটা আমরা মাঝে মাঝেই ব্যবহার করে থাকি । শরীর বিজ্ঞানের ভাষায় এর নাম হলো সারকেডিয়ান রিদম (Circadian Rhythm). মেলাটোনিন সরাসরি এই রিদমের উপরে প্রভাব বিস্তার করে। এর মাধ্যমেই আমরা বুঝতে পারি এখন খাওয়ার সময়, ঘুমানোর সময় কিংবা জেগে ওঠার সময়।
আশেপাশে অন্ধকার হয়ে আসলে Melatonin পরিমাণ বেড়ে যায়। এতে করে আমরা বুঝতে পারি, ঘুমানোর সময় হয়েছে। সকালে এর পরিমাণ কমে আসে। তখন আমরা বুঝতে পারি আমাদের জেগে উঠা উচিৎ।
মেলাটোনিন এর কাজ
মেলাটোনিন একটি গুরুত্বপূর্ণ হরমোন যা আমাদের শরীরে নানান ভাবে অবদান রাখে। নিচে এর কিছু দেওয়া হলো:
১. সারকেডিয়ান রিদমের পরিচালনা:
Melatonin এর মূল কাজ আমাদের সারকেডিয়ান রিদমকে ঠিক রাখা। আমাদের শারীরবৃত্তীয় নানা প্রকার কাজ এর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়।
২. ঋতুস্রাব নিয়ন্ত্রণে:
মেলাটোনিনকে মেয়েদের জন্য নির্ধারিত হরমোন যেমন: ইস্ট্রোজেন, প্রোজেস্টেরন ইত্যাদির সাথে মিলে কাজ করে ঋতুচক্র ঠিক মতো নিয়ন্ত্রণে খুবই দরকারি ভূমিকা পালন করে।
৩. স্নায়ুর ক্ষয়রোধে:
স্নায়ুর ক্ষয়রোধেও এর ভূমিকা রয়েছে যার ফলে আমরা এলজাইমার’স ডিজিস সহ নানা রকমের স্নায়ুরোগ থেকে মুক্তি পাই।
৪. বার্ধক্য বিলম্বকরণে:
নানা প্রকার সমস্যার কারণে অনেকেই শরীর থেকে পিনিয়াল গ্ল্যান্ড ফেলে দেন। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, তাদের বার্ধক্যজনিত সমস্যা শুরু হয় তুলনামূলকভাবে তাড়াতাড়ি। এই জন্য ধারনা করা হয় মেলাটোনিনের হয়ত বার্ধক্যের প্রক্রিয়া বিলম্বিত করার ক্ষমতা রয়েছে।
৫. অন্যান্য: এছাড়াও Melatonin আমাদের শরীরের তাপমাত্রা, ব্লাড প্রেশার, ব্লাড সুগার এবং ওজন নিয়ন্ত্রণেও সাহায্য করে।
যেভাবে মেলাটোনিন এর মাত্রা নির্ণয় করা যায়
একজন মানুষের থুথু, প্রসাব কিংবা রক্ত পরীক্ষা করে Melatonin এর পরিমাণ নির্ণয় করা সম্ভব। তবে মাধ্যম আলাদা হওয়ায় এদের রেফারেন্স ভ্যালুও আলাদা।
মেলাটোনিনের মাত্রা বৃদ্ধির উপায়:
অনেকক্ষেত্রে দেখা যায়, শরীরে উৎপন্ন মেলাটোনিনের পরিমাণ যথেষ্ট নয়। তখন এর পরিমাণ বৃদ্ধির জন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। এর অনেকগুলোই জীবন-যাপনের মানের সাথে সম্পর্কিত। নিচে এমন কিছু উপায় দেওয়া হলো:
- প্রতিদিন একই সময় ঘুম এবং একই সময়ে জেগে ওঠার মাধ্যমে একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ ঘুমের সময়সূচী বজায় রাখা।
- ঘুমানোর অন্তত দুইঘন্টা আগে থেকে উজ্জ্বল আলো এড়িয়ে চলুন, বিশেষ করে ইলেকট্রনিক ডিভাইস যেমন স্মার্টফোন এবং কম্পিউটার।
- সকালে উজ্জ্বল আলোর উপস্থিতি মেলাটোনিনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে একই সাথে ঘুমের মানও উন্নত করতে সাহায্য করতে পারে।
- ডায়েটে মেলাটোনিন রয়েছে এমন খাবারগুলি অন্তর্ভুক্ত করা, যেমন টার্ট চেরি, আখরোট এবং কলা।
- শোবার আগে মেলাটোনিন সাপ্লিমেন্ট নেওয়া যেতে পারে। বিশেষ করে যদি টাইম জোন পরিবর্তন বা রাত্রিকালিন শিফটে কাজ করার মতো কারণগুলির কারণে ঘুমাতে অসুবিধা হলে বা ঘুম-জাগরনের চক্র ব্যাহত হলে।
মেলাটোনিন এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
যদিও বলা হয় Melatonin সাপ্লিমেন্ট নিরাপদ এবং নেশা তৈরি করে না, তারপরেও দীর্ঘ ব্যবহারে এর কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে।
- দিনে ঘুম পাওয়া
- দুর্বলতা
- মাথা ঝিম ঝিম করা
- মাথা ব্যাথা
- বমি বমি ভাব
- শীত শীত ভাব
তবে কিছু ঔষধ আছে যাদের সাথে Melatonin বিক্রিয়া করতে পারে। এদের ভিতরে রয়েছে:
- ঘুমের ঔষধ
- রক্ত পাতলাকরণের ঔষধ
- উচ্চ রক্তচাপের ঔষধ
- ওরাল কন্ট্রাসেপটিক
- এন্টি ডিপ্রেসেন্ট
- ডায়াবেটিস এর ঔষধ
- ইমিউনোসাপ্রেসেন্ট ড্রাগস
গর্ভাবস্থায় এই হরমোনের ভূমিকা
গর্ভাবস্থায় Melatonin এর পরিমাণ খুব বেশি উঠা নামা করে। গর্ভকালীন শুরুর দিকে রাতের মেলাটোনিনের সর্বোচ্চ পরিমাণ কমে আসে। এজন্য অনিদ্রাভাব দেখা দেয়। কিন্তু প্রসবকালীন সময় যতই ঘনিয়ে আসে এর পরিমাণ ততই বাড়তে থাকে। বাচ্চা জন্ম দেওয়ার পর তা আবার স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরত যায়। গর্ভকালীন সময়ে অমরাতে মায়ের শরীরে এই Melatonin সরবরাহ করে থাকে যা ভ্রূণের সারকেডিয়ান রিদম ঠিক করে স্নায়ুর বিকাশে ভূমিকা রাখে।
বার্ধক্য এবং মেলাটোনিন
বয়সকালীন সময়ে আমাদের পিনিয়াল গ্লান্ড এর কর্মক্ষমতা হারায়, এর ফলে কমে আসে মেলাটোনিনের পরিমাণ। তাই বয়স্ক লোকদের অনিদ্রা খুবই সাধারণ একটি সমস্যা।
আমাদের শারীরিক সুস্থতায় Melatonin এর অবদান অনস্বীকার্য। তবে কেও সাপ্লিমেন্ট হিসেবে এটি নিতে চাইলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। সেক্ষেত্রে অবশ্যই ডাক্তারকে অন্যকোনো ওষুধ গ্রহণ করছে কিনা তাও সাথে সাথে জানাতে হবে, না হলে ডাক্তারের পক্ষে সঠিক পরিমাণ নির্ধারণ করা কষ্টসাধ্য হয়ে উঠবে।