আমাদের শরীরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কোটি কোটি স্নায়ুর এক সুবিশাল নেটওয়ার্ক। কিন্তু এক স্নায়ু থেকে অন্য স্নায়ু তা শরীরের যে প্রান্তেই থাকুক না কেন, বয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে একমাত্র এই নিউরোট্রান্সমিটার গুলোর জন্যই। আমাদের হাতে একটা মশা বসেছে সেই সিগন্যাল আমাদের হাতের সেই স্থানের নিউরন এই নিউরোট্রান্সমিটারের মাধ্যমে খবর পাঠাবে আমাদের মস্তিষ্ককে আর এরপরে মস্তিষ্ক থেকে আমাদের অপর হাতের পেশীকে সিগন্যাল দিবে মশাটাকে মেরে ফেলার জন্য। এই পুরো প্রক্রিয়া কোনো সময়ই সম্ভব হতো না যদি না এই কেমিক্যাল মেসেঞ্জারগুলো সাহায্য করতো।
নিউরোট্রান্সমিটার বা Neurotransmitter কি?
নিউরোট্রান্সমিটার বা Neurotransmitter হচ্ছে আমাদের দেহের রাসায়নিক বার্তাবাহক কিংবা কেমিক্যাল মেসেঞ্জার (Chemical Messenger). এরা আমাদের শরীরে এক স্নায়ুকোষ থেকে সংকেত বহন করে নিয়ে যায় বিভিন্ন গন্তব্যস্থলে। এই গন্তব্য হতে পারে অন্য কোনো স্নায়ু/ নিউরন (Neuron), কোনো পেশী কিংবা কোনো গ্রন্থি (Gland).
এই কেমিক্যাল মেসেঞ্জারগুলো আমাদের পেশী নাড়াতে, অনুভব করতে, হার্টকে সচল রাখতে কিংবা দূরের কোনো গ্রন্থি থেকে হরমোন নিঃসরণ করতে সাহায্য করে ।
নিউরোট্রান্সমিটার এর কাজ
নিউরোট্রান্সমিটার আমাদের শরীরে নানা রকমের কাজ করে থাকে। নিচে এর কিছু উল্লেখ করা হলো:
- হৃৎস্পন্দন ও রক্তচাপ
- শ্বাস-প্রশ্বাস
- পেশীর সঞ্চালন
- চিন্তা, স্মৃতি, মনোযোগ এবং মনে রাখা
- ঘুম, ক্ষয় পূরণ
- বয়োবৃদ্ধি
- হরমোনাল রেগুলেশন (Hormone Regulation)
- হজম ক্রিয়া, ক্ষুধার অনুভূতি
- ইন্দ্রিয়জাত অনুভূতি সমূহ যেমনঃ দর্শন, শ্রবণ, স্পর্শ, ঘ্রাণ, স্বাদ ইত্যাদি
নিউরোট্রান্সমিটার এর প্রকারভেদ (Types of Neurotransmitter)
যেহেতু নিউরোট্রান্সমটারের সংখ্যা অনেক সেহেতু এদেরকে বেশ কিছু ভাগে ভাগ করা সম্ভব।
কাজের উপরে ভিত্তি করে এটি ৩ ধরণের:
- এক্সাইটেটোরি (Excitatory)- এক স্নায়ু থেকে অন্য স্নায়ুতে কেমিক্যাল সিগন্যাল চলতে থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত না গন্তব্যে পৌছায়।
- ইনহেবিটরি (Inhibitory)- কোনো একটি কেমিক্যাল সিগন্যালকে বন্ধ করে দেয়।
- মডিউলেটরি (Modulatory) - এরা অন্য নিউরোট্রান্সমিটারকে প্রভাবিত করতে পারে।
রাসায়নিক গঠনের উপর ভিত্তি করেও এটি ৩ প্রকার:
- এমাইনো এসিড জাত (Amino acids Neurotransmitter)
- মনোএমাইন জাত (Monoamine Neurotransmitter)
- পেপটাইড জাত (Peptide Neurotransmitter)
এমাইনো এসিড-জাত নিউরোট্রান্সমিটার
১। গ্লটামেট (Glutamate): এটি আমাদের মস্তিষ্কের এক্সাইটোরি নিউরোট্রান্সমিটার। আমাদের চিন্তা-ভাবনা, স্মৃতি, নতুন কিছু শেখা ইত্যাদি কাজে সাহায্য করে। এলজাইমার’স ডিজিস (Alzheimer’s disease), স্মৃতিভ্রম (Dementia) , পারকিনসন’স ডিজিস (Parkinson's Diseases) ইত্যাদি রোগ এর সাম্যতা নষ্টের সাথে সম্পর্কযুক্ত।
২। গ্লাইসিন (Glycine): যেসব ইনহেবিটরি নিউরোট্রান্সমিটার সবচেয়ে বেশি পরিমাণে পাওয়া যায় তার একটি গ্লাইসিন যা থাকে মেরুরজ্জুতে। শ্রবণ, মেটাবলিজম, ব্যথার অনুভূতি ইত্যাদির সাথে এই কেমিক্যাল মেসেঞ্জারটি জড়িত।
মনোএমাইন জাত নিউরোট্রান্সমিটার
১। সেরোটোনিন (Serotonin): এটি একটি ইনহেবিটরি নিউরোট্রান্সমিটার। এটি আমাদের ঘুমানোর সময়সূচী, মানসিক অবস্থা, দুশ্চিন্তা, রুচি, ব্যথা ইত্যাদি বিষয়সমুহকে নিয়ন্ত্রণ করে। এটির সাম্যতা নষ্ট হলে সিজনাল এফেক্টিভ ডিসঅর্ডার (Seasonal Affective Disorder) , দুশ্চিন্তা, ফাইব্রোমায়ালজিয়া (Fibromyalgia), হতাশা ইত্যাদি সমস্যার জন্ম হতে পারে।
২। হিস্টামিন (Histamine): এটি আমাদের জেগে থাকা, খাওয়া-দাওয়া, কাজ করার আগ্রহ ইত্যাদির সাথে সম্পর্কযুক্ত। একই সাথে এটির সম্পর্ক রয়েছে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা যেমন এজমা (Asthma), ব্রঙ্কোস্পাজম (Bronchospasm), মিউকোসাল এডিমা (Mucosal Edema)
৩। ডোপামিন (Dopamine): এটি অনেকটা আমাদের শরীরের আনন্দানুভূতির কেমিক্যাল মেসেঞ্জার। আমাদের আনন্দ, উদ্দীপনা, নতুন কিছু শেখার সাথে সম্পর্কিত। একই সাথে আমাদের মনোযোগ, ঘুম, স্মৃতি, মনের অবস্থা, কাজ করার প্রেরণা ইত্যাদি ব্যাপারেও মুখ্য ভূমিকা রাখে। সিজোফ্রেনিয়া (Schizophrenia), বাই পোলার ডিসঅর্ডার (Bipolar Disorder), ADHD ইত্যাদি রোগের সাথেও এর অসাম্যতা সম্পর্কিত।
৪। এপিনেফ্রিন (Epinephrine): যার অপর নাম হচ্ছে এড্রেনালিন (Adrenalin)। ভয়, ক্লান্তির মতো ব্যাপারগুলো সাথে মোকাবেলা করার জন্য উদ্দীপনা, সাহস যোগায় এই নিউরোট্রান্সমিটার। হার্ট রেট, ব্লাড স্যুগার, রক্ত সংবহন ইত্যাদি ব্যাপারগুলোর সাথে এটি সম্পর্কিত। অনেকক্ষেত্রে এটি ওষুধ হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।
৫। নরএপিনেফ্রিন (Norepinephrine): এর আরেক নাম নরএড্রেনালিন (Noradrenalin)। এটি অনেকটা এপিনেফ্রিন এর মতোই। ফোকাস ও মনোযোগ বাড়াতে এটি ওষুধ হিসেবে অনেককেই নিতে বলা হয়।
পেপাটাইড নিউরোট্রান্সমিটারঃ
এন্ডোনেফ্রিন (Endonephrine): এরা হলো আমাদের শরীরের প্রাকৃতিক ব্যথানাশক। কিছু ধরণের মাথাব্যথা এবং ফাইব্রোমিয়ালগিয়াতে এটি ব্যবহার করা যেতে পারে।
নিউরোট্রান্সমিটার কাজ না করার কারণসমূহ
অনেক সময় দেখা যায় বিভিন্ন কারণে আমাদের শরীরে কেমিক্যাল মেসেঞ্জার গুলো ঠিক মতো কাজ করতে পারে না। নিচে এর কিছু কারণ দেওয়া হলো:
- প্রয়োজনের চেয়ে কম বা মাত্রাতিরিক্ত উৎপন্ন হলে।
- যদি রিসিভার ঠিক মতো কাজ না করে।
- ইনফ্লেমেশন (Inflammation) এর কারণে।
- প্রয়োজনের চেয়ে দ্রুত শোষিত হয়ে গেলে।
- এনজাইম নিউরোট্রান্সমিটারের কাজে বাধা প্রদান করলে।
এটি কাজ না করলে কি হতে পারে?
যেহেতু নিউরোট্রান্সমিটার আমাদের শরীরে নানা রকমের কাজে নিয়োজিত সেহেতু এগুলো কাজ না করলে আমাদের নানা রকমের শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। তবে এইসব কেমিক্যাল মেসেঞ্জারের কাজ নিয়ে এখনো অনেক গবেষনা প্রয়োজন। এজন্য সব সমস্যা নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবু নিচে কিছু সম্ভাব্য সমস্যা উল্লেখ করা হলো:
- এসিটাইলকোলিন কম উৎপন্ন হলে এলজাইমার’স ডিজিস হতে পারে।
- মাত্রাতিরিক্ত সেরোটোনিন অটিজম (Autism) এর সাথে সম্পর্কিত হতে পারে।
- মাত্রাতিরিক্ত নরএপিনেফ্রিন এবং ডোপামিন নির্গত হলে তা ম্যানিয়াতে (mania) রূপ নিতে পারে। এক্ষেত্রে মানুষ অপ্রয়োজনীয় পরিমাণে কর্ম-উদ্দীপনা দেখায়। এসময় ঘুম কমে আসে এবং মাথায় খুব দ্রুত নানা চিন্তা ঘুরপাক খায়।
যেসকল খাবার নিউরোট্রান্সমিটারের লেভেলকে প্রভাবিত করতে পারে
এমন অনেক খাবার আছে যা নিউরোট্রান্সমিটার এর পরিমাণের উপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। নিচে কয়েকটি উল্লেখ করা হলো:
- ডোপামিন: চকলেট, কাঠবাদাম, চিনা বাদাম, আপেল ইত্যাদি।
- এন্ডোনেফ্রিন: অলিভ ওয়েল, কমলা, আঙুর, প্রাণীজ আমিষ ইত্যাদি।
- সেরোটোনিন: দুধ, আনারস ইত্যাদি।
আমাদের শরীরে প্রায় প্রতিটা-ক্ষেত্রেই নিউরোট্রান্সমিটারের কোনো না কোনোভাবে অবদান রয়েছে। মোট কথা এদের ছাড়া স্বাভাবিক কাজ করা সম্ভব না। এদের পরিমাণ কম বা বেশি হলে আমাদের দেহের স্বাভাবিক কার্যকলাপ বাধাগ্রস্ত হয় । কিছু কিছু ওষুধ সরাসরি এদের উপরে প্রভাব রাখতে পারে। তাই আমাদের সতর্ক থাকতে হবে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ নেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।