ব্লাড সুগার (Blood Sugar) কি? ব্লাড সুগার কম রাখার উপায়

ব্লাড সুগার (Blood Sugar) কি? 

আমাদের রক্তে বেশ কিছু রকমের সুগারের উপস্থিতি রয়েছে। যার মাঝে Glucose ই প্রধান এবং প্রায় অধিকাংশ পরিমাণে এর উপস্থিতিই দেখা যায়। ব্লাড সুগার হলো আমাদের রক্তে Glucose এর উপস্থিতি। এটি আমাদের শরীর সারা দেহে শক্তির প্রবাহ নিশ্চিত করে।

আমরা যখন নানা রকমের খাবার খাই তখন শর্করা জাতীয় খাবারের একাংশ ভেঙ্গে গ্লুকোজ রূপে রক্তে চলে আসে। রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ হলো ব্লাড সুগার লেভেল

আদর্শ ব্লাড সুগার লেভেল

একজন সুস্থ পূর্ণবয়স্ক মানুষের জন্য আদর্শ ব্লাড সুগার লেভেল হলো ৭০ থেকে ৯৯ mg/dL. মানুষভেদে ৫০-৭০ mg/dL থাকলেও তাকে স্বাভাবিক বলে ধরা হয়। মিলিমোল পার লিটারের হিসাবে না খাওয়া অবস্থায় এই মাত্রা ৪ থেকে ৭। খাবার না খাওয়া অবস্থাতেই এটা মাপা উত্তম। একে ফাস্টিং সুগার লেভেল বলে। 

এই লেভেল যখন ১০০ থেকে ১২৫ mg/dL হয়ে যায় অথবা ৭ mmol/litre এর উপরে চলে যায় তখন ধরা হয় মানুষটা প্রি ডায়াবেটিক অর্থাৎ সে টাইপ-২ ডায়াবেটিক হওয়ার ঝুঁকিতে আছে। এই মাত্রা ১২৬ বা তার উপরে চলে যাওয়ার সাধারণ অর্থ হলো মানুষটার টাইপ-২ ডায়াবেটিক আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। যাদের টাইপ-২ ডায়াবেটিস রয়েছে তাদের ব্লাড সুগার যদি খাওয়া পর ৮.৫ এর ভিতরে থাকে তবে তা স্বাভাবিক ধরে নেওয়া হয়। 

Blood Sugar এর সাথে  Insulin ও Glucagon এর মাঝে সম্পর্ক: 

রক্তে সুগার লেভেল বৃদ্ধি বা হ্রাসের পেছনে দুইটি হরমোন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। একটি হলো ইনসুলিন আরেকটি হলো Glucagon. আমাদের শরীরের অগ্ন্যাশয় (pancreas) এই দুই রকমের হরমোন নিঃসরণ করে। Glucagon আমাদের লিভারে গ্লাইকোজেনকে ভেঙ্গে glucose এ পরিণত করে। আর ইনসুলিন glucose কে আমাদের দেহের নানা রকম কোষের যোগান দেয়।

একসাথে Insulin এবং Glucagon আমাদের দেহে একটি সাম্যতা বজায় রাখে। একটি আরেকটির পরিপূরক হিসেবে কাজ করে। এদের কোনো একটির পরিমাণ বেড়ে বা কমে গেলে আমাদের দেহে Blood Sugar বেড়ে বা কমে যায়। 

যখন আমাদের রক্তে Glucose এর পরিমাণ স্বাভাবিকের তুলনায় বেড়ে যায় তখন অগ্ন্যাশয় Insulin ক্ষরণ করে যা আমাদের রক্তে সুগার কমাতে সাহায্য করে, এর পরে যখন তা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি কমে যায় তখন অগ্ন্যাশয় আবার Glucagon নিঃসরণ করে যা সুগারকে আবার বাড়তে সাহায্য করে। চক্রাকার প্রক্রিয়ায় এই পুরো কাজগুলো বার বার চলতেই থাকে। আর আমাদের দেহে স্বাভাবিক Glucose এর মাত্রা নিশ্চিত হয়। 

বিভিন্ন কারণে আমাদের শরীরে এই সাম্যতা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এমন হতে পারে, সব সময় অতিরিক্ত গ্লুকোজ থাকার কারণে শরীর একটানা ইনসুলিন তৈরি করেই যাচ্ছে। এই ঘটনা চলতেই থাকলে দুই রকমের ফলাফল হতে পারেঃ

  1. অগ্ন্যাশয় ইনসুলিন তৈরি অনেক পরিমাণে তৈরির ক্ষমতা  একটা সময় হারিয়ে ফেলবে
  2. শরীরে তৈরিকৃত ইনসুলিন আর কাজ করছে না, একে ইনসুলিন রেসিস্টেন্স বলা হয়। যার ফলাফল টাইপ-২ ডায়াবেটিস

আবার শরীরে Glucagon এর মাত্রা অনেক কমে গেলে রক্তে প্রয়োজনীয় পরিমান সুগারও থাকে না। এই সমস্যা প্রাণঘাতীও হতে পারে। তখন বাহ্যিকভাবে এই হরমোন গ্রহণের প্রয়োজন হয়। 

ব্লাড সুগার মনিটোরিং: 

রক্তের সুগার কি পরিমাণে আছে তা পর্যবেক্ষণে রাখাটা ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য দরকারি। অনেকক্ষেত্রেই তাদের প্রতিদিনের মাত্রা টুকে রাখার প্রয়োজন হয়। নিচের তালিকা তাদের জন্য উপকারী সাব্যস্ত হতে পারে। 

রেফারেন্স ভ্যালু  নিজের লক্ষ্য ফলাফল

খাবারের আগে: 

৪ - ৭ mmol/litre

_________ থেকে ________

মাত্রা:
তারিখ:
সময়:
নোটঃ: 

খাবারের পরে:
<৮.৫ mmol/litre 

_________ থেকে ________

মাত্রা:
তারিখ:
সময়:
নোট: 

এখানে রেফারেন্স ভ্যালু বলতে যার কম আর বেশি হওয়া অনুচিত। কিন্তু আমাদের নিজেদের কিছু লক্ষ্য থাকতে পারে যে আমরা এই সীমা থেকে এই সীমার মাঝে রাখবো। এই ব্যাপারে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে মাত্রা নির্ধারণ করা উত্তম। উপরের তালিকাটি টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য। আলাদা আলাদা রকমের সমস্যার রোগীদের তালিকার রেফারেন্স ভ্যালু আলাদা হতে পারে। এই সময় আমাদের শর্করা জাতীয় খাবার গ্রহণে সতর্ক থাকতে হবে এবং কমিয়ে সহনীয় মাত্রায় নিয়ে আসতে হবে। 

ব্লাড সুগার কম রাখার উপায়ঃ

আমরা অনেক সময়ই নানা রকমের শারীরিক সমস্যার সমাধানে মুঠো মুঠো ঔষধের দিকে ঝুঁকে পড়ি। কিন্তু আমরা চাইলে নিজেরাই এগুলো মোকাবেলা করতে পারি। Blood Sugar কমানো এর ব্যতিক্রম নয়। নিচে কিছু উপায় উল্লেখ করা হলো:

  1. প্রয়োজনীয় পরিমান পানি খেতে হবে, পানি শরীর থেকে অপ্রয়োজনীয় বর্জ্যপদার্থ নিষ্কাশন করে। একই সাথে এটি অতিরিক্ত ইনসুলিনকেও শরীর থেকে বের করে দেয়।
  2. গ্লাইসেমিক ইনডেক্স এ উপরের দিকে আছে এমন খাবার পরিহার করতে হবে। যেমনঃ আলু, চিনি
  3. শরীরচর্চা আমাদের শরীর থেকে অতিরিক্ত চর্বিকে ছেটে ফেলতে সাহায্য করে। তাই প্রতিদিন নিয়মমাফিক ব্যায়াম সুগার লেভেলকে ঠিক রাখতে মুখ্য ভূমিকা রাখতে পারে।
  4. কিছু খাবার আছে যেগুলো ব্লাড সুগারকে কমাতে সাহায্য করে। যেমনঃ সবুজ শাক সবজি, পরিমিত পরিমানে বাদাম, গাজর, সবুজ আপেল, ব্রকলি ইত্যাদি।
  5. যাদের ডায়াবেটিস রয়েছে তাদের নিয়মিত Blood Sugar পরিমাপ করা প্রয়োজন। নিয়ম মেনে চলার পরও যদি এর পরিমান না কমে তবে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।

ব্লাড সুগার কমাতে প্রয়োজনীয় খাবারঃ

যেহেতু Blood Sugar লেভেলের সাথে খাবার ওতপ্রোতভাবে জড়িত সেহেতু এমন কিছু খাবার নিশ্চয় আছে যেগুলো আমাদের খাদ্যতালিকাতে নিয়ে আসা দরকার। নিচে এমন কিছু খাবারের কথা বলা হলো যারা পুষ্টিগুণে অনন্য কিন্তু সুগার লেভেলকে খুব বেশি বাড়িয়ে তোলে না।

  1. শাক-সবজি- সবুজ শাকসবজি নানা রকম ভিটামিন মিনারেলস এর উৎস। যেমনঃ পালং শাক, পুই শাক, লাউ শাক, ব্রকলি, ঢেঁড়স
  2. বিচি জাতীয় খাদ্য- শিমের বিচি, কুমড়োর বিচি, সুর্যমুখীর বিচি, চিয়া সিড
  3. সামুদ্রিক খাবার - নানা রকমের মাছ, চিংড়ি, স্কুইড
  4. নানা রকমের ডাল - মুগ ডাল, ছোলার ডাল, মটর ডাল, মসুর ডাল
  5. নানা রকমের ফল - লেবু, কমলা, মাল্টা, জাম্বুরা, এভোকাডো, কিউই, বেরি জাতীয় ফল, সবুজ আপেল। 
  6. ফার্মেন্টেটেড খাবার - কিফার, কিমচি, টক দই ইত্যাদি
  7. ওটস এবং ওটস দিয়ে তৈরি নানা রকমের খাবার।

উপরের তালিকার খাবার Blood Sugar কমাতে সাহায্য করে। কিন্তু তাই বলে এই সকল খাবারও অতিরিক্ত পরিমানে খেলে আমাদের জন্য হীতে বিপরীর হতে পারে। তাই আমাদের জানতে হবে কোন খাবার কি পরিমানে দৈনিক গ্রহণ করা যাবে।

যেসকল খাবার ব্লাড সুগার বাড়িয়ে দেয়ঃ 

কিছু খাবার আছে যেগুলো দ্রুত রক্তে সুগারকে বাড়িয়ে তোলে। আমার কিছু খাবার আছে যেগুলো অতিরিক্ত পরিমাণে গ্রহন আমাদের জন্য ক্ষতিকর। নিচে সংক্ষেপে তালিকা দেওয়া হলো:

  1. মিষ্টি জাতীয় খাদ্য - মিষ্টি, পেস্ট্রি, কেক , বিস্কুট, আইস্ক্রিম ইত্যাদি।
  2. আলু ও আলু দিয়ে তৈরিকৃত খাবার- ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, আলুর চপ, পটেটো চিপস। 
  3. অতিরিক্ত পরিমাণে শর্করা ও চর্বি জাতীয় খাবার- ভাত, আটা।
  4. কিছু ধরণের ফল যা কম খাওয়া উচিৎ - আনারস, তরমুজ।
  5. কিছু ফল যা পরিমিত পরিমাণে খাওয়া উচিৎ - কলা, আম।

ব্লাড সুগার মাপার আদর্শ সময়:

বিশেষজ্ঞদের মতে, দিনে কমপক্ষে ৫ থেকে ৬ বার ব্লাড সুগার মাপা উচিত। প্রথমবার পরীক্ষা করতে হবে সকালে খালি পেটে। তবে এই ক্ষেত্রে নিশ্চিত হতে হবে যেন পরীক্ষার দশ ঘন্টা আগে খাবার খাওয়া হয়েছিলো। এরপরে সকালের নাস্তার দুইঘন্টা পর আবার মাপতে হবে। 

দুপুরের খাবার খাওয়ার ৩০ মিনিট আগে আবার রক্তে সুগার মেপে নিতে হবে। এর পরের পরীক্ষা হবে রাতের খাবারের আগে এবং রাতের খাবারের দুই ঘন্টা পর। তবে প্রতিবার একই রকম ফলাফল আসার সম্ভাবনা কম। আমাদের খেয়াল রাখতে হবে Blood Sugar যে পরিমানে থাকা দরকার সেই পরিমানে আছে কিনা। যদি কোনো কারণে প্রয়োজন হয় তবে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। 

Blood Sugar নিয়ে কিছু প্রশ্নোত্তর: 

১. রক্তে সুগার কি যত কম থাকবে ততই ভালো?

উ: মোটেই না। বরং রক্তে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণে সুগার থাকা বাঞ্ছনীয়। প্রয়োজনের তুলনায় সুগারের পরিমাণ কমে গেলে প্রচণ্ড ক্লান্তি, দুর্বলতা ছাড়াও অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, মস্তিষ্কে চাপ পড়া ইত্যাদি সমস্যা হতে পারে যা অনেকক্ষেত্রেই প্রাণঘাতী। 

২. শুধু বয়স্কদেরই রক্তের সুগার নিয়ে সতর্ক থাকতে হবে? 

উ: এই কথাটাও ঠিক না। অনেক বাচ্চাদেরও ডায়াবেটিস হতে পারে। আবার অনেক তরুণ-তরুণীরা আছেন যারা প্রি ডায়াবেটিক, তাদের জন্য Blood Sugar মনিটরিং প্রয়োজন।

৩. রক্তে সুগারের স্বাভাবিক মাত্রা কত? 

উঃ একজন সুস্থ পূর্ণবয়স্ক মানুষের জন্য আদর্শ ব্লাড সুগার লেভেল হলো ৪ থেকে ৭ mmol/litre কিংবা ৭০ থেকে ৯৯ mg/dL.

৪. ব্লাড সুগার মাপার জন্য কোন আঙ্গুল ব্যবহার করা উত্তম? 

উঃ রক্তে সুগার মাপার জন্য মধ্যাঙ্গুলি কিংবা অনামিকা আঙ্গুল (Ring Finger) ব্যবহার করা উত্তম। 

৫. ব্লাড সুগার পরিমাপে ভুল ফলাফল আসার কারণ কি হতে পারে?

উঃ পানিশুন্যতা জনিত সমস্যা, রক্ত স্বল্পতা কিংবা ইউরিক এসিডের পরিমান বেশি থাকলে Blood Sugar টেস্টের ফলাফল ভুল আসতে পারে। 

৬. স্ট্রেস কি ব্লাড সুগার বাড়িয়ে দিতে পারে? 

উঃ জি, একজন মানুষ একটানা স্ট্রেস এ থাকলে তা রক্তে সুগার লেভেল বাড়িয়ে দিতে পারে। 

৭. Blood Sugar কমে যাওয়ার বা হাইপোগ্লাইসেমিয়া এর কারণ কি?

উঃ নিয়মিত খাবার গ্রহণ না করা, শর্করা কম আছে এমন ডায়েট অনুসরণ করা, অতিরিক্ত পরিশ্রম, অতিরিক্ত ইনসুলিন গ্রহণ ইত্যাদি কারণে Blood Sugar কমে যেতে পারে। 

৮. ব্লাড সুগার কত হলে ডায়াবেটিস হয়?

উঃ ফাস্টিং ব্লাড সুগার 126 mg/dL বা 7.0 mmol/L বা তার বেশি হলে, ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।