কিসমিসের উপকারিতা ও পুষ্টিতথ্য

হাতের মুঠোয় কিসমিস নিয়ে অল্প অল্প করে খেতে কে না ভালোবাসে। নানা রকমের মিষ্টি জাতীয় খাবারের যোগ্য সঙ্গী হিসেবেও এর তুলনা নেই। অনেক রকমের রান্নার কৌশলেও কিসমিস ব্যবহার করা হয়। কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না, এই কিসমিস শুধু স্বাদবর্ধকই নয়, একই সাথে এটি পুষ্টিবর্ধকও। 

কিসমিস মুলত আঙ্গুর শুকিয়ে তৈরি করা হয়। এই শুকানোর প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন রকমের খনিজ ও ভিটামিনের পরিমাণ পরিবর্তিত হয় এবং অনেক ক্ষেত্রে বেড়েও যায়। বিভিন্ন খাবারের সাথে আমরা সকাল কিংবা বিকালের নাস্তা হিসেবে কিসমিস খেতে পারি। যা আমাদের খাবারের স্বাদ বৃদ্ধি করবে এবং একই সাথে আমাদের বিভিন্ন রকমের পুষ্টি উপাদানেরও যোগান দিবে। 

কিসমিসের পুষ্টি উপাদানের তথ্য

কিসমিসকে বলা হয় দ্রুত ওজন বর্ধক। আমাদের মাঝে  যারা ওজন স্বল্পতা ও নিন্ম রক্তচাপে ভুগছেন তাদের জন্য এটি ভালো পথ্য হতে পারে। আমরা যদি কিসমিসের পুষ্টি উপাদান সমুহের দিকে লক্ষ্য করি তবে সহজেই এর উপকারিতা সম্পর্কে অনুধাবন করতে পারবো। 

২৫ গ্রাম  কিসমিসের পুষ্টি উপাদান:

প্রোটিন ৪%
কার্বহাইড্রেট ৯৪% (যার অধিকাংশই Fructose)
ফ্যাট ২% 
ক্যালরি ৭৮ 
ফাইবার ১.২ গ্রাম
ট্রান্স ফ্যাট ০% 

----------------------------------------------------------------------

কপার ০.১ মিগ্রা (দৈনিক চাহিদার ৮%)
পটাশিয়াম ১৯৩ মিগ্রা (৪%)
আয়রন ০.৫ মিগ্রা (৩%)
ক্যালসিয়াম ১৬.১ মিগ্রা (১%)

----------------------------------------------------------------------

ভিটামিন বি২ (দৈনিক চাহিদার ৩%)
ভিটামিন বি৬ (৩%)
ভিটামিন সি (১%)
ভিটামিন কে (১%)

----------------------------------------------------------------------

বিভিন্ন রকমের এমাইনো এসিড
ওমেগা ৩ ফ্যাটি এসিড
এন্টি এক্সিডেন্ট 

উপরে যে তালিকা দেওয়া হয়েছে তা শুধুমাত্র ২৫ গ্রাম কিসমিস থেকে পাওয়া সম্ভব। উপরের তালিকা থেকে একটি বিভ্রান্তি আসতে পারে, আর তা হলো কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ। তবে এই ক্ষেত্রে একটি ব্যাপার স্বস্তিদায়ক, কিসমিসের মুল শর্করা হলো Fructose। এই শর্করা জাতীয় উপাদানটি খুবই ধীর গতিতে ব্লাড সুগারে পরিবর্তন আনে এবং ইনসুলিন এর মাত্রাকে খুব একটা পরিবর্তন করে না। 

কিসমিসের উপকারিতা

নিচে বিস্তারিত কিসমিসের পুষ্টি উপাদান ও পুষ্টি গুণাবলি নিয়ে আলোচনা করা হলো: 

১. শক্তি বর্ধক ও ওজনবর্ধক: 

কিসমিস ওজন ও পুষ্টিবর্ধক। যাদের ওজন আদর্শ মান অপেক্ষা কম তাদের জন্য কিসমিস পুষ্টির একটি ভালো উৎস হতে পারে। এতে যে শর্করা রয়েছে তা শরীরের জন্য উত্তম এবনফ গ্লুকোজের মতো তীব্র শারীরিক প্রতিক্রিয়া তৈরি করে না। 

আবার এই ব্যাপারটিও মনে রাখা প্রয়োজন যে প্রতিটি মানুষের চাহিদা আলাদা। সবাই ওজন কমাতে চায় না। অনেকের জন্য ওজন বৃদ্ধিও একই রকম গুরুত্বপুর্ণ। কিসমিস এই ক্ষেত্রেও সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। 

যারা কঠোর পরিশ্রম করে থাকেন তারা চাইলে নিয়মিত কিসমিস খেতে পারেন। এটি ধীরে ধীরে কিন্তু একটানা শরীরে প্রয়োজনীয় শক্তি সরবরাহ অব্যাহত রাখে। এর ফলে একজন মানুষ দীর্ঘ সময় ধরে প্রয়োজনীয় শক্তি অর্জন করতে পারে। 

২. হজমে সহায়ক: 

প্রতিদিন কিসমিস খাবারের সাথে গ্রহণ করা মানবদেহের ক্ষুদ্রান্ত্রের জন্য উপকারী। এটি হজম প্রক্রিয়াকে সহজ করে। বদহজমজনিত সমস্যাকে দূরে রাখে। একই সাথে এটি ডিটোক্স হিসাবেও কাজ করে এবং শরীর থেকে অপ্রয়োজনীয় টক্সিন দূর করতে সাহায্য করে। 

কিসমিস ডায়েটারি ফাইবারে পরিপূর্ণ। ফাইবার পানির সংস্পর্শে স্ফিত হয়ে ওঠে এবং পেট পরিষ্কার করতে সাহায্য করে। কিসমিস কৌষ্ঠকাঠিন্য দূর করে এবং মলত্যাগের প্রক্রিয়াকে সহজ করে। আধা কাপ কিসমিসে যে পরিমাণে ফাইবার রয়েছে তা দৈনিক চাহিদার ১০% থেকে ২৫%.

 ৩. রক্তস্বল্পতা দূরীকরণে: 

কিসমিসে প্রচুর পরিমাণে আয়রন ও ভিটামিন বি কমপ্লেক্স রয়েছে। এই সকল ভিটামিন ও মিনারেল রক্তস্বল্পতা বা অ্যানিমিয়া দূর করে। কিসমিসে প্রচুর পরিমাণে কপারও রয়েছে। কপার লোহিত রক্ত কণিকা তৈরিতেও ভূমিকা রাখে। 

একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, প্রায় ৫০% -৬০% বয়স্ক ব্যাক্তিদের মাঝে রক্ত স্বল্পতাজনিত সমস্যা দেখা যায়। একই সাথে সন্তানসম্ভাবা ও প্রসূতি নারীদের ক্ষেত্রেও এই সমস্যাটি দেখা যায়। এই সকল সমস্যা মোকাবেলায় কিসমিস আয়রন সাপ্লিমেন্ট এর সহায়ক হিসেবে কাজ করতে পারে। 

৪. ক্যান্সার প্রতিরোধ: 

কিসমিসে প্রচুর পরিমাণে ডায়েটারি ফাইবার রয়েছে। ফাইবার রেক্টাল ক্যান্সার প্রতিরোধে কাজ করে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, যারা অধিক ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করে থাকে তাদের মলদ্বারের ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা কম। 

একই সাথে, কিসমিসে ক্যাটাচিন নামের এন্টি অক্সিডেন্ট রয়েছে। ক্যাটাচিন ক্যান্সার কোষ সৃষ্টির জন্য দায়ী ফ্রি র‍্যাডিকেলের বিপক্ষে কাজ করে। এর ফলে ক্যান্সার কোষ তৈরি হতে এবং আকারে বৃদ্ধি পেতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। 

৫. যৌন জীবনের উন্নতিতে: 

কিসমিসে প্রচুর পরিমাণে আর্জেনিন নামক এমাইনো এসিড রয়েছে। এই এমাইনো এসিড স্বাভাবিক যৌন আকাঙ্খা এবং সুস্থ্য যৌন জীবনের জন্য অত্যাবশ্যক। এটি যৌনাকাঙ্খা বৃদ্ধি করে এবং প্রয়োজনীয় হরমোন তৈরিতে সাহায্য করে। 

একই সাথে যৌন মিলনের আগে ও পরে কিসমিস খাওয়া হলে মিলন দৈর্ঘস্থায়ী হয় এবং মিলন পরবর্তী দূর্বলতা দেখা দেয় না। এটি অত্যন্ত পুরাতন পন্থা যা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে এখনো মেনে চলা হয়। 

৬. দৃষ্টিশক্তির উন্নতিতে: 

কিসমিসের রয়েছে polyphenolic phytonutrients (পলিফেনোলিক ফাইটোনিউট্রিয়েন্টস)। এটি হলো এমন একটি এন্টি অক্সিডেন্ট যা দৃষ্টিশক্তি সচল রাখতে সাহায্য করে। এমন অনেক পদার্থ রয়েছে যারা ধীরে ধীরে দৃষ্টিশক্তি ও ফোকাস করার ক্ষমতা কমিয়ে ফেলে। পলিফেনোলিক ফাইটোনিউট্রিয়েন্ট এই সকল পদার্থকে নিষ্ক্রিয় করে চোখের স্বাভাবিক দৃষ্টি ধরে রাখতে সাহায্য করে। 

এছাড়াও কিসমিস ভিটামিন এ, বিটা ক্যারোটিন এবং ক্যারোটিনয়েডের বিশাল উৎস। এই প্রতিটি পদার্থই আদর্শ দৃষ্টিশক্তি ধরে রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। 

৭. ব্রেইন ফাংশনের উন্নতি: 

বিভিন্ন রকমের এন্টি অক্সিডেন্ট, এন্টি এজিং এবং ফাইটোনিউট্রেন্ট রয়েছে যেগুলো মস্তিষ্কের ফাংশন উত্তম উপায়ে পরিচালনা করতে সাহায্য করে। এমন কিছু উপদান কিসমিসে পাওয়া যায়। পলিফেনলস, টেনিন, ফেনোলিক এসিড ব্রেইন ফাংশনকে স্বাভাবিক রাখে। এই সকল পদার্থ কগনেটিভ ফাংশন ও স্মৃতিশক্তির উন্নতিতেও কাজ করে। 

এছাড়া কিসমিস ভিটামিন সিতে পরিপূর্ণ। এই ভিটামিনও কগনেটিভ ও মোটর ফাংশনের উন্নতিতে অবদান রাখে। একই সাথে ইমিউন সিস্টেমকেও শক্তিশালী করে। 

৮. ত্বকের যত্নে: 

কিসমিস ত্বকের অনেক উপকার করে। কিসমিস ভেতর থেকে আমাদের ত্বকে সুরক্ষা প্রদান করে। ফলে ভেতর থেকে কোনো প্রকারের ক্ষয় তৈরি হতে পারে না। একই সাথে এতে উপস্থিত বিভিন্ন রকমের এন্টি অক্সিডেন্ট ফ্রি র‍্যাডিকেলের সাথে মোকাবেলা করে ত্বক কুচকে যাওয়া, বলিরেখা, বয়সের ছাপের মতো সমস্যা প্রতিরোধ করে। 

কিসমিসে এমন অনেক ফাইটোক্যামিকেল রয়েছে যা সুর্যের অতি বেগুনী রশ্মি থেকে সৃষ্ট সমস্যা থেকে ত্বককে রক্ষা করে। অতিরিক্ত ক্ষতি থেকে বাচিয়ে দেয়। কিসমিসের ভিটামিন এ এবং ই, ত্বকের স্তরের নিচে নতুন কোষ তৈরি করতে সাহায্য করে। নতুন কোষ তৈরির ফলে ত্বক সজীব ও মসৃণ থাকে।

৯. রক্ত বিশুদ্ধকরণে: 

ডিটক্স হিসাবে কিসমিসের জনপ্রিয়তা দিন দিন বেড়েই চলেছে। কালো কিসমিস লিভারের ডিটক্সিফিকেশন ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করে। এর ফলে শরীরে খুব দ্রুত ক্ষতিকর পদার্থ শরীরে থেকে বের করে দেয়। 

কিসমিসের রেসভেরাটল নামে এক ধরণের রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে যা রক্ত থেকে অশুদ্ধি ও মৃত কোষ দূর করে। একই সাথে এটি শরীরে লোহিত রক্ত কণিকার পরিমাণও বৃদ্ধি করে। এসিডোসিস নামের রক্তের টক্সিসিটির বিপক্ষে এটি কাজ করে। রক্তের অম্ল ও ক্ষারের সমতা রক্ষা করতে সাহায্য করে।

 ১০. চুলের যত্নে: 

কিসমিসে এমন অনেক ভিটামিন, মিনারেল ও রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে যা চুলের স্বাস্থ্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। এর মাঝে রয়েছে, ভিটামিন বি, আয়তন পটাসিয়াম, জিংক এবং বিভিন্ন রকমের এন্টি অক্সিডেন্ট। এদের প্রতিটিই চুলের জন্য উপকারী। 

আয়রন স্বল্পতা চুলকে প্রাণহীন করে তোলে এবং চুল পড়া বাড়িয়ে দেয়। আয়রন চুলের গোড়ায় রক্ত সরবরাহে সাহায্য করে এবং পুষ্টি সরবরাহ সহজ হয়। নিয়মিত কিসমিস খেলে চুলে খুসকির পরিমাণ কমে যায়, নতুন চুল গজানো বৃদ্ধি পায়। 

সতর্কতা: 

কিসমিস নিয়ে কিছু সতর্কতা পালন করা উচিত: 

যাদের অতিরিক্ত ওজন কিংবা ওজন বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে তাদের পরিমিত পরিমাণে কিসমিস খাওয়া উচিত। ডায়াবেটিস এর রোগীদের ক্ষেত্রেও কিসমিস খাওয়ার ব্যাপারে সতর্কতা পালন করা উচিত। 

আকারে ছোট হলেও কিসমিস একটি বলদায়ক ও পুষ্টিদায়ক খাবার যা চাইলেই আমরা আমাদের খাবারের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে পারি। নিয়মিত কিসমিস সেবন আমাদের মস্তিস্ক, রক্ত সংবহন তন্ত্র, চুল, ত্বকের জন্য খুবই উপকার বয়ে আনতে পারে। তবে যারা স্থুলতা সমস্যায় ভুগছেন কিংবা নিজের ওজন নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তাদের কিসমিস খাওয়ার পরিমাণ সীমিত করা আবশ্যক।